সকল প্রাকৃতিক সম্পদই নিলামে তোলার প্রয়োজন নাই, সরকার অন্য পদ্ধতিতেও তাহার বণ্টন করিতে পারে, সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিবার ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল ইউ পি এ জোট সরকার। তৎসহ ভারতও। ভারতের কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সি এ জি) একটি সংবিধান-সিদ্ধ প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তাহার মূল্যায়নের রীতি ও তীব্রতা সরকার তথা প্রশাসনকে প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। যে কোনও মন্ত্রক জনসম্পদ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত লইলে দুর্নীতির অভিযোগের অঙ্গুলি উঠিতে পারে, এই দুশ্চিন্তায় সিদ্ধান্ত লইবার প্রক্রিয়াটিই ঝুঁকিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। সক্রিয়তার তুলনায় নিষ্ক্রিয়তাই যখন সরকারের নিকট নিরাপদ ঠেকে, তখন গণতন্ত্রের ঘোর দুর্দিন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নীতি প্রণয়ন যে সরকারেরই কাজ, এই মৌলিক সত্যটি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করিয়া আদালত গণতন্ত্রকে রক্ষা করিল।
সুপ্রিম কোর্ট যে যুক্তি দিয়াছে, তাহার সার বুঝিতে কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট সর্বাধিক লাভ করাই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য নহে, জনস্বার্থে সরকার অপর কোনও উপায়েও প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টন করিতে পারে। আদালত মনে করাইয়া দিয়াছে, প্রশাসন সরকারের কাজ, তাই প্রশাসনিক নীতিও সরকারকেই ঠিক করিতে হইবে। জনস্বার্থে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন, তাহা বিবেচনা করিবার অধিকার সরকারেরই। এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারি তোষাখানায় কম টাকা জমা পড়িয়াছে, কেবল এই যুক্তিতে কোনও সিদ্ধান্তকে জনবিরোধী বলিয়া ধরা ঠিক নহে। তাই জনসম্পদ নিলামে তুলিতেই হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা সরকারের উপর নাই। তাহার অর্থ এই নহে যে, ইউ পি এ সরকার টু জি বণ্টন কিংবা কয়লা খনি বণ্টনের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত লইয়াছে, তাহার সবই ন্যায্য। ইউ পি এ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা নিয়ম লঙ্ঘন করিয়াছেন কি না, দুর্নীতি করিয়াছেন কি না, সেই প্রশ্নগুলির আদালতে মীমাংসা হইতে এখনও বাকি আছে। তবে সরকারের নীতিগত অবস্থানে যে কোনও ভ্রান্তি নাই, ইহা প্রতিষ্ঠিত হইল।
এই রায়ের ফলে ভারতে গণতন্ত্রের একটি গুরুতর সংকটও কাটিল। গণতন্ত্র এমন একটি প্রশাসন পদ্ধতি, যাহার ব্যবস্থাপনা দাঁড়াইয়া রহিয়াছে ভারসাম্য রক্ষার উপর। নানা জনগোষ্ঠীর, নানা আর্থ-সামাজিক শ্রেণির পরস্পর-বিরোধী স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা গণতন্ত্রের কাজ। তাহা সাধন করিবার উপায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা। সেই কাজটি সহজ নহে, মাঝে মাঝেই বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘাত ঘনাইয়া উঠিবার ফলে কেবল সরকার কিংবা নেতাদের নহে, দেশের গণতন্ত্রকেই বিপন্ন করিয়া ফেলে। ‘সি এ জি’ ভারতীয় গণতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, কারণ প্রশাসনে স্বচ্ছতা, পারদর্শিতা, অপচয় এবং দুর্নীতির প্রতিরোধ করিবার কাজটি তাহার। নাগরিকদের নিকট সরকারের দায়বদ্ধতা বজায় রাখিবার দায়িত্ব তাহার উপরেই অর্পণ করিয়াছে সংবিধান। সেই নিয়মানুসারে ‘সি এ জি’ যে সরকারের সমালোচনা করিবে, ইহাই স্বাভাবিক। কিন্তু সম্প্রতি এই শীর্ষ অডিট সংস্থাটি কোথায়, কত আর্থিক ক্ষতি বাস্তবিক হইয়াছে তাহার বিবেচনা অতিক্রম করিয়া, সরকারি নীতি অন্য রকম হইলে কত আর্থিক লাভ হইতে পারিত, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতির হিসাব করিতেছিল। বহু শূন্য-সমন্বিত, কল্পনারও দুঃসাধ্য এক একটি সংখ্যাকে ‘ক্ষতির পরিমাণ’ বলিয়া জনসমক্ষে পেশ করা হইতেছিল। স্বভাবতই বিরোধীরা উত্তেজিত, জনতা বিক্ষুব্ধ সংসদে, মন্ত্রকে, সর্বত্রই অচলাবস্থা তৈরি হইয়াছিল। সুপ্রিম কোর্ট মনে করাইয়া দিল যে, ক্যাগের কাজ আর্থিক মূল্যায়ন, নীতি নির্ধারণের কাজ সরকারের। ভারসাম্য রক্ষা পাইল, গণতন্ত্রও। |