চাকমা জনগোষ্ঠীর পুথি সংরক্ষণে গুরুত্ব দিচ্ছে ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব লিপিতে লেখা এ ধরনের শ’দুয়েক পুথির সন্ধান পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথি সংরক্ষণ কেন্দ্র। এর মধ্যে বেশ ক’টি পশু-চামড়ার মলাট দেওয়া। ত্রিপুরায় চাকমাদের কাছেই রয়েছে এমন পুথি।
তাদের নিজস্ব লিপিতে এ পর্যন্ত যে-ক’টি পুথির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি অবশ্য খুব পুরনো নয়। এক থেকে দুশো বছর আগেকার বলে জানিয়েছেন সংরক্ষণ কেন্দ্রের ডিরেক্টর সত্যদেও পোদ্দার। তাঁর কথায়, উপজাতি সম্প্রদায়ের ওই সময়ের মানুষরা যে পুথি রচনা করেই দায়িত্ব সারেননি, এর সংরক্ষণের কথাও ভেবেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ওই সব পুথির অধিকাংশই রয়েছে যারা ঝাড়ফুঁক করেন, ওষুধ-তাবিজ দেন, সেই সব ওঝাদের কাছে। এরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে সেই সব পুথি তুলে দিতে নারাজ। এরই মধ্যে কিছু পুথি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহে এসেছে।
সাহিত্য আকাদেমির ভাষাসম্মানপ্রাপ্ত লেখক, নিরঞ্জন চাকমার কথায়, “চাকমা লিপিতে রচিত পুথির অধিকাংশই কাগজের ওপর লেখা। কিছু আছে গাছের বাকল, বাঁশ বা তালপাতার। সেগুলি আবার বাঘ, হরিণ, ভল্লুক, অজগর প্রভৃতি পশুর চামড়ায় মলাট দেওয়া। খোলামেলা থাকলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এই আশঙ্কাতেই বিভিন্ন চামড়ার মোড়কে সেগুলি সুরক্ষিত রাখা হত।
আধুনিক কালের পুথি সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতো না হলেও একে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা যে তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন, তাকেই সাধুবাদ জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথি সংরক্ষণ কেন্দ্রের গবেষকরা। বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য সেগুলিকে এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সুরক্ষার কথা ভাবছে। পোকামাকড় যাতে না ধরে তার জন্য নানা ওষুধ দিয়ে পরে লাল কাপড়ে মুড়ে রাখা হবে। আর ওই পশুর চামড়ার মোড়ক? সত্যদেওবাবু জানান, সেগুলি মোড়ক হিসেবে রেখেই ওর ওপর লাল কাপড় মোড়া হবে। পরবর্তী ক্ষেত্রে চাকমা পণ্ডিতদের ডেকে পাঠোদ্ধার ও সম্পাদনার কাজ শুরু করা হবে। চলবে সেগুলির বাংলা-ইংরেজি অনুবাদও। সব শেষে ডিজিটাল চেহারায় রূপান্তর।
এরই পাশাপাশি ব্যক্তিগত সংগ্রহের পুথিগুলিও যাতে রক্ষা করা যায়, তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। সেই কারণে চাকমা অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সচেতনতা সভার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে পেচারথলে অনুষ্ঠিত হয় একটি সভা। ক’দিনের মধ্যে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযান। তবে সভার বদলে তাঁরা গুরুত্ব দিচ্ছেন বাড়ি-বাড়ি গিয়ে আলোচনায়।
নিরঞ্জনবাবুও আশাবাদী, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রয়াসে নিশ্চয় সাড়া মিলবে। কারণ সংরক্ষণের জন্য পুথিগুলি সংরক্ষণ কেন্দ্রে দিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, বাড়িঘরে রেখেও পরামর্শমতো সেগুলি সুরক্ষিত রাখা যায়। পুথি সংরক্ষণে গ্রামবাসীদের উৎসাহিত করে চলেছেন ত্রিপুরা স্বশাসিত উপজাতি এলাকা পরিষদের কার্যবাহী সদস্য সন্ধ্যারানি চাকমাও।
ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯-এর ডিসেম্বরে চালু হয় এই পুথি সংরক্ষণ কেন্দ্র। এখন সেখানে বাংলা, সংস্কৃত, মণিপুরি, মগ ও চাকমা মিলিয়ে শ’তিনেক পুথি রয়েছে। সন্ধান চলছে ককবরক ও জমাতিয়া ভাষায় লেখা পুথিরও। |