দীর্ঘদিন ধরে বাড়ির বাইরে থাকা, চেয়েও ছুটি না-পাওয়া ইত্যাদি কারণে অবসাদ থেকেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মতো আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানেরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে এত দিন মনে করা হত। কিন্তু বাহিনীর কর্তারা দেখেছেন, ইদানীং জওয়ানদের মধ্যে পারিবারিক কারণেও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিএসএফের অফিসারেরা জানান, প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাড়ি থেকে ফেরার পরেই জওয়ানেরা আত্মহত্যা করছেন। এর মোকাবিলায় মূলত দ্বিমুখী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে। কাউন্সেলিং আর লম্বা ছুটি বাড়ানো।
পারিবারিক কারণে সেপ্টেম্বরেই দুই জওয়ানের আত্মহত্যার কথা জানা গিয়েছে বিএসএফ সূত্রে। নাগাল্যান্ডে ডিউটি করছিলেন রাজস্থানের টাম্বারাম। সবে ছুটি কাটিয়ে ফিরেছিলেন। তার পর থেকেই অসম্ভব চুপ মেরে যান বিএসএফ বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওই জওয়ান। কারণ খুঁজতে গিয়ে অফিসারেরা তাঁর বাড়িতে অশান্তির কথা জানতে পারেন। তাঁর দু’ভাইকে ডেকে পাঠানো হয়। জয়সলমের থেকে দু’ভাই এসে টাম্বারামের সঙ্গে দু’দিন থাকেন, তাঁকে বোঝান। কিন্তু দু’ভাই চলে যেতেই গত ১৫ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা করেন টাম্বা।
সবে গত বছর সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে ঢুকেছিলেন মেদিনীপুরের স্নেহাশিস প্রধান। পাহারার কাজে যুক্ত ছিলেন জলপাইগুড়িতে। এক মাস ছুটি নিয়ে পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেন। |
সাল |
সংখ্যা |
২০০৯ |
১৩ |
২০১০ |
১৪ |
২০১১ |
২১ |
২০১২ (অগস্ট পর্যন্ত) ১৫ |
|
কিন্তু বাড়ির লোকজন সেই বিয়ে মেনে নেননি। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভিযোগ, অন্যত্র বিয়ে করায় স্নেহাশিসের উপরে শুরু হয় চাপ। সহ্য করতে না-পেরে ৭ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা করেন তিনি।
দু’টি ক্ষেত্রেই বিএসএফ দেখেছে, যে-অবসাদ থেকে দুই জওয়ান আত্মহননের মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার মূলে আছে পারিবারিক ঝামেলা। সেই জন্য কাউন্সেলিংকেই হাতিয়ার করা হচ্ছে। জওয়ানেরা বাড়ি থেকে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কম্যান্ডান্ট পদের অফিসারেরা তাঁদের কাউন্সেলিং করতে বসছেন। ছুটি কাটাতে গিয়ে জওয়ানটি বাড়িতে কেমন ছিলেন, তাজা হয়ে ফিরেছেন নাকি মনমরা ভাব বেড়েছে, সেই দিকে নজর রাখছেন বাহিনীর কর্তারা।
এর সঙ্গেই আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের ছুটিছাটার ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিল করার পথেও হাঁটছে কেন্দ্রীয় সরকার। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এডিজি বংশীধর শর্মা রবিবার কলকাতায় জানান, জওয়ানদের ক্ষেত্রে বছরে তিন বার লম্বা ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়া বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “বছরে দু’বার এক মাস করে এবং এক বার ১৪ দিনের ছুটি দেওয়া শুরু হয়েছে জওয়ানদের। অনেকটা জোর করেই ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে।” পারিবারিক কোনও সমস্যা থাকলে যাতে তার সমাধান করার জন্য বেশি সময় পাওয়া যায়, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা বলে মন্তব্য করেছেন এডিজি।
কিন্তু ছুটি দিলেই যে সমস্যা কমছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাড়ি থেকে ফেরার পরেই আত্মহত্যা করছেন জওয়ান। অনেক ক্ষেত্রে নিয়মিত মোবাইল ফোনে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার ফলেও সমস্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অফিসারেরা। এডিজি শর্মার কথায়, জওয়ানেরা বাড়িতে গিয়ে হাজারো সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। সেই সব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের দিশা না-পেয়ে তাঁদের অবসাদ বাড়ছে। তার জেরে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। সেই কারণেই ছুটি বাড়িয়ে পরিজনদের সান্নিধ্যে বেশি সময় কাটানোর ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে জোর দেওয়া হচ্ছে কাউন্সেলিংয়ের উপরে। কাজের মধ্যে কোনও জওয়ানের মধ্যে চূড়ান্ত অবসাদ দেখা দিলে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কল্যাণ তহবিলের টাকা খরচ করে প্রয়োজনে তাঁর বাড়ি থেকে আত্মীয়দের ডেকে আনা হচ্ছে। যেমন হয়েছিল টাম্বারামের ক্ষেত্রে। যদিও শেষ পর্যন্ত ওই জওয়ানকে অবসাদ-দানবের গ্রাস থেকে রক্ষা করা যায়নি।
শুধু সীমান্তরক্ষী বাহিনী নয়, অবসাদে আত্মনাশের প্রবণতা দেখা দিয়েছে সিআইএসএফ বা শিল্প নিরাপত্তা বাহিনী এবং সিআরপি-তেও। সিআইএসএফ সূত্রের খবর, অবসাদে ভোগা জওয়ানদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ চলছে সেখানেও। কয়েক দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ আসার কথা। সিআরপি-র আইজি বিবেক সহায় বলেন, “জওয়ানদের জন্য উন্নত মানের থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোনও জওয়ানকে অবসাদে ভুগতে দেখা গেলে সিনিয়র অফিসারেরা তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন।” |