এক সময় যে যন্তর-মন্তরে বিক্ষোভের অর্থই ছিল লাল ঝান্ডার ঢেউ, সেখানেই ধর্নায় বসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাঁদের আন্দোলনের হাতিয়ারই মমতা কী ভাবে কেড়ে নিচ্ছেন, তা নিয়ে চুলচেরা বিচার চলছে বাম শিবিরে। অভিযোগ উঠছে বড় শরিক সিপিএমের দিকেই। বামফ্রন্টের শরিকদের পাশাপাশি সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন বা অন্যান্য বাম দলগুলির বিশ্লেষণ, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল নেত্রী যদি বামেদের পরিসর দখল করে থাকেন, তার জন্য সিপিএম তথা বামেরাই দায়ী। জনগণের বিষয়-ভিত্তিক আন্দোলন থেকে সরে আসার ফলেই মমতা তার সুযোগ নিয়েছেন।
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের মতো সংস্কারের প্রতিবাদ করলেও মনমোহন সরকারের এই সিদ্ধান্ত যে বামেদের সামনে আন্দোলনের সুযোগ এনে দিয়েছে, সে বিষয়ে সকলেই একমত। কিন্তু সেই সুযোগ যে তাঁরা নিতে পারছেন না, তা নিয়েও দ্বিমত নেই বাম শিবিরে। এক দিকে ইগো-র সমস্যা, অন্য দিকে নির্বাচনী ফায়দার কথা ভাবতে গিয়ে সিপিএম সব বামেদের একত্র করে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে না বলে মনে করছে অন্য বাম দলগুলি। দিল্লিতে রবিবার মনমোহন সরকারের দুর্নীতি ও সংস্কারের বিরুদ্ধে সিপিআই (এম-এল)-সহ ছোট বামগুলির ডাকা সম্মেলনে সিপিএমের গরহাজিরায় নতুন করে সেই অভিযোগ উঠেছে। সিপিএমের নাম না-করলেও ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা দেবব্রত বিশ্বাস কটাক্ষ করেছেন, “বাম ঐক্যের ক্ষেত্রে ইগোর সমস্যাই বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
দিল্লির সম্মেলনে প্রশ্ন উঠেছে, যদি এফডিআই-বিরোধিতায় বিজেপি-মুলায়মের সঙ্গে এক মঞ্চে যেতে পারলে অন্য বাম দলগুলির মঞ্চে যেতে আপত্তি কোথায়? সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত প্রসেনজিৎ বসুর কটাক্ষ, “প্রণবকে রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন করলে, নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে ছবি তুললে বা মুলায়মের হাত ধরলে বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য এগোবে না!”
লিবারেশন নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য অবশ্য মনে করছেন, মমতা বামেদের আন্দোলনের পরিসর কেড়ে নিচ্ছেন বলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তাঁর যুক্তি, “মানুষ যথেষ্ট বিচক্ষণ। মমতা এত দিন টু-জি, কমনওয়েলথ বা কয়লা দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলেননি। এখন তিনি সরব হয়েছেন। কাজেই কারা সুবিধাবাদী রাজনীতি করছে আর কারা মানুষের স্বার্থে আন্তরিক বিরোধিতা করছে, তা কিছু দিনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।” কিন্তু সিপিএম-ই যে আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে মমতাকে সুযোগ করে দিয়েছেন, সেই অভিযোগও তুলছেন দীপঙ্কর। তাঁর সঙ্গে একমত সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি নেতারা। মমতার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানকে সিপিএম যে চোখে দেখছে, তা নিয়েও ভিন্ন মত আছে বাম শিবিরে। কলকাতায় সিপিআইয়ের রাজ্য পরিষদের বৈঠকে দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গুরুদাস দাশগুপ্ত যেমন বলেছেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, রেলের পরিষেবা কর বাড়ানো বা খুচরো ব্যবসায় এফডিআই-ই শেষ নয়। মনমোহন সরকারের দক্ষিণপন্থী সংস্কারের তালিকায় এর পর পেনশন, ব্যাঙ্ক বা বিমা আছে। এই পথের প্রতিবাদে মমতা যখন ইউপিএ ছেড়ে চলে এসেছেন, তখন তাঁকে অনাবশ্যক আক্রমণ করা উচিত নয়। বরং ইউপিএ-র ভিতর থেকেই এই ধরনের প্রতিবাদ উঠে আসার বিষয়টিকে বামেদের আন্দোলনের যুক্তি হিসাবে ব্যবহার করা উচিত। এমনকী, বিধানসভায় এফডিআই প্রস্তাব পাশ হওয়ার আগে বাম বিধায়কদের ওয়াকআউটে ভুল বার্তা গিয়ে থাকতে পারে বলেও মনে করছে সিপিআইয়ের একটি গোষ্ঠী।
তবে অন্য দুই বাম শরিক আরএসপি এবং ফ ব এই প্রশ্নে মমতাকে রেয়াত করতে রাজি নয়। আরএসপি-র রাজ্য কমিটিতে এ দিনই আলোচনা হয়েছে যে, মমতার রাজনীতি প্রকৃত অর্থে বামপন্থী নয়। তিনি বাম রাজনীতির পরিসর
কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যেটা আটকাতে নিজেদেরই সচেষ্ট হতে হবে। ফ ব-র রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ শনিবারই এক কনভেনশনে বলেছেন, মমতা মুখে বামপন্থী কথা বলে অ-বামপন্থী আচরণ করছেন।
বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় শরিক হিসাবে ফ ব কী ভাবে খুচরো ব্যবসায় বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল, সেই দৃষ্টান্ত দিয়ে দলের যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অনির্বাণ চৌধুরী ৮ অক্টোবর সব জেলায় কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরের সামনে প্রতীকী মানব বন্ধনের ডাক দিয়েছেন।
মমতার হাতে আজ যে পরিসর হারাতে হচ্ছে, তা ধরে রাখতে বামেদেরও যে প্রভূত ব্যর্থতা ছিল, তা নিয়ে অবশ্য বাম শিবিরেই আত্মসমালোচনা চলছে। আরএসপি নেতা অবনী রায় মনে করছেন, “আসলে মানুষ আমাদের আন্দোলনের উপরেই ভরসা হারিয়ে ফেলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের ক্ষমতাবদল সেই কারণেই হয়েছে।” আর দেবব্রতবাবুর মতে, “আমরা এক বার ভাবছি, মুলায়মের পিছনে গেলে লাভ হবে, এক বার ভাবছি, লালুর পিছনে গেলে লাভ হবে!”
তথাকথিত বামপন্থী হয়ে মমতা অদ্ভুত টানাপোড়েনে ফেলে দিয়েছেন বাম দলগুলিকে! |