বছর বারোর মেয়েটাকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখেছিলেন বেজিংয়ের উ রুই। ভরসা বলতে ছিল মেয়েটাই। কিন্তু পঞ্চাশ পার করা উ-কে এখন নিজের পাশাপাশি বয়স্ক বাবা-মার দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে।
সামান্য পেনশনে দিন চলে না। হঠাৎ ওষুধপত্রের জন্য বাড়তি খরচ ঘাড়ে চাপলে কী হবে, জানেন না উ। এই সমস্যাটা শুধু উ রুইয়ের নয়।
চিনে এক সন্তান নীতির প্রভাবে কোনও পরিবারে দাদু-দিদিমা এবং দাদু-ঠাকুরমার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মাও আর্থিক ভাবে মাত্র এক জনের উপরেই নির্ভরশীল। ১৯৮০ সাল থেকে এই নিয়ম চালু হওয়ার পর থেকে দেশ জুড়ে দশ লক্ষ পরিবার তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে হারিয়েছেন। আগামী ২০-৩০ বছরে আরও ৪০ থেকে ৭০ লক্ষ পরিবারকে এই অবস্থার শিকার হতে হবে বলে জানাচ্ছেন চিনের পরিসংখ্যানবিদরা।
উ রুই এখন বাড়িতেই বেশির ভাগ সময় কাটান। উল বোনেন। আর বদ্ধ রান্নাঘরে সবার জন্য খাবার তৈরি করেন। উ-এর ৮০ বছরের বাবা কানে শুনতে পান না। ছোট্ট ঘরে বিছানার এক কোণে পড়ে থাকেন। দড়ি থেকে ঝোলে একটা বাল্ব। আর ফাটা দেওয়াল গিলতে আসে উ-কে। ওষুধের খরচের চেয়েও উ-এর বড় ভয়, লরঝরে বাড়িটাই না কোনও দিন ভেঙে দেওয়া হয়। বেজিংয়ের বেশির ভাগ ভগ্নদশার বাড়ির ক্ষেত্রে সেটাই করা হয় যে। বাড়ি না থাকলে যদি কোনও অ্যাপার্টমেন্টে উঠতে হয়, তা কিনতে যা খরচ হবে উ-এর মাসিক পেনশন তার চেয়ে অনেক কম।
অথচ ২০০১ সালে জাতীয় আইন অনুযায়ী, যে সব পরিবার তাদের একমাত্র সন্তানকে হারাবে, স্থানীয় সরকার তাদের প্রয়োজনীয় সব রকম সাহায্য করবে। কিন্তু সেই সব সাহায্য যে কী, তা স্পষ্ট করে কোথাও বলা নেই। সিচুয়ান প্রদেশে যেমন সেই সব সন্তানহারা পরিবার ফের সন্তানধারণের আর্জি জানাতে পারে। সাংহাইয়ে এ সব ক্ষেত্রে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, বেজিংয়ে এই রকম ক্ষেত্রে পরিবারপিছু মাসে ২০০ ইউআন দেওয়া হয়। আর ওই সব পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে সঙ্গ দিতে পাঠানো হয় যুবক-যুবতীদের।
নিয়ম যতই থাকুক, সেগুলো কোনওটাই বিশেষ কাজে লাগে না বলে মনে করেন আমেরিকার শিক্ষাবিদ ই ফুক্সিয়ান। চিনের পরিবার-পরিকল্পনার নীতির সমালোচনা করে তিনি বলছেন, “এ দেশে মৃত্যুহারের পরিসংখ্যান আমরা খতিয়ে দেখেছি। তার মধ্যে ২৫ বছর বয়সের আশপাশে মৃত্যুর সংখ্যা হিসেব করলে বলতে হয়, চিনের ২১ কোটি ৮০ লক্ষ পরিবারের ৪.৬৩ শতাংশ কিন্তু তাদের একমাত্র সন্তানকে হারাবে। সেই পরিবারগুলোর কী হবে?” ফুক্সিয়ানের পাশাপাশি জনগণনা-বিশেষজ্ঞরাও মানছেন এক সন্তান নীতি দ্রুত বন্ধ করা উচিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকাতে এই নীতি প্রাথমিক ভাবে কার্যকর হলেও তৈরি হয়েছে অন্য সমস্যা। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ চিনে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই দখল করে নেবেন ষাট পেরনো মানুষেরা। গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রে যে হার ২০ শতাংশ। আর ২০০০ সালে চিনে যে হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। বেজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গু বাওচ্যাং বলছেন, “এক সন্তান নীতি প্রয়োগের পরে ৩২ বছর কেটে গিয়েছে। অভিভাবকদের প্রথম প্রজন্ম বার্ধক্য ছুঁয়েছে। তাই গণ্ডগোলটা এত দিনে বোঝা যাচ্ছে।”
তাই ফুক্সিয়ানের মতো অনেকেই মনে করছেন চিন এখন জন্মহার বাড়াতেই পারে। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা এবং পরিবার পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান লি বিন বলছেন, “যে নিয়ম মেনে আমরা চলছি, সেটাই মেনে চলা দরকার।” তবে বয়স্ক-জনসংখ্যার হার বৃদ্ধির বিষয়টাও উদ্বেগের, মানছেন লি। তাই হয়তো কিছু কিছু পরিবারকে এক সন্তান নীতির নিয়ম থেকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা আরও আগে হওয়ার দরকার ছিল বলে মনে করেন বাওচ্যাং। বেজিংয়ের উ-এর মতো অসংখ্য মানুষকে তাই শুধু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাড়া করে বেড়ায় না। পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে একটা অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে তাদের। |