|
|
|
|
বছর পার, এখনও খুলল না হার্টের ভাল্ভ ও চামড়ার ব্যাঙ্ক |
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
এক সপ্তাহ ধরে কার্যত মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে ১৪ বছরের অম্বালিকা বসু। আগুনে ৬৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে বারাসতের ন’পাড়া স্কুল রোডের বাসিন্দা এই কিশোরী। লড়াইটা একটু সহজ হত এক সপ্তাহের মধ্যে কিছুটা চামড়া পেলে। তাতে তার পোড়া দেহ থেকে প্লাজমা প্রোটিন বার হওয়া অনেকটা আটকানো যেত। কিন্তু সাত দিন কোন ছাড়, গত এক বছরেও এসএসকেএম হাসপাতালে রাজ্যের একমাত্র ‘স্কিন ব্যাঙ্ক’ থেকে কোনও অগ্নিদগ্ধ রোগী চামড়া পাননি। কারণ, রাজ্য সরকার এই ব্যাঙ্ক চালুর ছাড়পত্র দিলেও এসএসকেএম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, তাঁরা গত এক বছরেও ‘স্কিন ব্যাঙ্ক’-এর প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরির ‘সময় পাননি!’
শুধু ‘স্কিন ব্যাঙ্ক’ই নয়, সরকারি সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরে একই ভাবে গত এক বছর ধরে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাজ্যের একমাত্র ‘হার্ট ভাল্ভ ব্যাঙ্ক’। সেখানে ভাল্ভ-প্রার্থীদের তালিকায় অপেক্ষমাণ রোগীর সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে আরও ১০০ জনের নাম জমা পড়ছে। কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, ঘরের ছাদে জল বসছে বলে ভাল্ভ ব্যাঙ্ক চালু করা যাচ্ছে না। এ দিকে, কবে হার্ট ভাল্ভের ব্যাঙ্ক চালু হবে, তার দিকে তাকিয়ে গত দেড় মাস ধরে ধুঁকে-ধুঁকে দিন গুনছেন সুন্দরবনের মেয়ে ১৭ বছরের মুনমুন পাখিরা, হাসনাবাদের বছর পঁয়ত্রিশের বিকাশ মজুমদারেরা। এঁদের হার্টের দু’টি ভাল্ভই অকেজো। হাজার-হাজার টাকা দাম দিয়ে ভাল্ভ কেনার ক্ষমতা নেই। একমাত্র প্রাণে বাঁচতে পারেন কোনও মৃতদেহ থেকে ভাল্ভ পেলে।
দিন কয়েক আগে স্বাস্থ্য দফতরে একটি চিঠি লিখেছেন অম্বালিকার বাবা অলককুমার বসু। ২০১১-র সেপ্টেম্বরে যে স্কিন ব্যাঙ্ক চালুর ছাড়পত্র স্বাস্থ্য দফতর দিয়েছে, তা কেন এক বছরেও চালু হল না, তা জানতে চেয়েছেন তাতে। প্রশ্ন তুলেছেন, কেন অসহায় ভাবে নিজের মেয়েকে চামড়ার অভাবে তিলে-তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে দেখতে হবে বাবাকে।
এসএসকেএম হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরাই অভিযোগ করেছেন, “যত বার কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, সব বিভাগীয় প্রধানকে নিয়ে একটি বৈঠক ডেকে স্কিন ব্যাঙ্কের প্রক্রিয়া শুরু করা হোক, তত বার ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ তা পিছিয়ে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে চামড়া না-পেয়ে অম্বালিকার পাশাপাশি সঙ্কটজনক অবস্থায় বার্ন ওয়ার্ডে রয়েছেন গার্ডেনরিচের নগমা খাতুন, খানাকুলের কাকলি সাঁতরা-রাও।”
এসএসকেএম কর্তৃপক্ষের জবাব, “এত দিনে স্কিন ব্যাঙ্ক চালু হওয়া তো উচিত ছিল। মূল সমস্যা হল উপযুক্ত কর্মী জোগাড় করা। তা ছাড়া, সংগৃহীত চামড়া সংরক্ষণের জন্য মাইনাস ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রার একটি ফ্রিজ কেনার দরকার ছিল। তার জন্য দরপত্র ডাকা হলেও বহু দিন পর্যন্ত সরকারের নির্দিষ্ট বাজেট অনুযায়ী কোনও সংস্থা ফ্রিজ সরবরাহ করতে আগ্রহ দেখায়নি। অবশেষে কিছু দিন আগে একটি সংস্থা ওই ফ্রিজ সরবরাহে রাজি হয়েছে।”
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে হার্ট ভাল্ভের ব্যাঙ্ক খাতায়-কলমে চালু হয়েছিল ২০১১ সালের অগস্টে। বেসরকারি হাসপাতালে একটি হার্ট ভাল্ভ বসাতে গেলে প্রায় ৫৫-৭০ হাজার টাকার মতো খরচ। সরকারি হাসপাতালে সেটা হত ৪০-৪২ হাজার টাকায়। সেখানে হার্ট ভাল্ভ ব্যাঙ্ক চালু হলে মৃতদেহ থেকে সংগৃহীত ভাল্ভ মাত্র পাঁচ-ছয় হাজার টাকায় শরীরে বসিয়ে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হত। কিন্তু বছর ঘুরে গেলেও সেটা শুধু স্বপ্ন হয়ে থেকে গিয়েছে। হার্ট ভাল্ভ ব্যাঙ্ক তালাবন্ধ হয়ে পড়ে। কেন?
হার্ট ভাল্ভ ব্যাঙ্কের দায়িত্বে থাকা আর জি করের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের চিকিৎক ভবতোষ দত্তের যুক্তি, “একতলার ঘরের দেওয়াল বারবার ড্যাম্প হয়ে যাচ্ছে, যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। এখানে ভাল্ভ রাখলেই নষ্ট হয়ে যাবে।”
তা হলে প্রথম বার দেওয়ালে জল বসার পরেই ঘর বদলানো হল না কেন? ভবতোষবাবুর জবাব, “বদলে কোথায় যাব? এই হাসপাতালে আর ঘর কোথায় যে, যেখানে ভাল্ভ তৈরি ব্যাঙ্ক করা যাবে? এত দিনে তিনতলায় একটি ঘর পাওয়া গিয়েছে। সেখানেই ভাল্ভের ব্যাঙ্ক সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।” স্বাস্থ্য-ভবনের একাংশ অবশ্য এই দেরির পিছনে আর্টিফিশিয়াল হার্ট ভাল্ভের কারবারিদের ‘চাপ’-এর কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না। |
|
|
|
|
|