গবেষণার ফল দেখে অবাক বিজ্ঞানীরাই
রোগের সঙ্গে যুঝতে পাল্লা ভারী মোটাদেরই
কালে ঘুম থেকে উঠেই ডায়েট চার্ট দেখে শুরু হল দিন। মেপে খাওয়া, সময় মেপে জিমে যাওয়া, জগিং, যোগ-ব্যায়াম। তার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মেপে নেওয়া। একটু কি ‘স্লিম’ হওয়া গেল? ওজন কি কমল? বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লাম না তো?
স্লিম হওয়ার সংক্রামক প্রতিযোগিতায় আক্রান্ত গোটা বিশ্বের কাছে মোটা লোকেরা তাই অনেকটা ভিন্ গ্রহের বাসিন্দা। রোগা হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ায় নিজেদের নিয়ে কম বিব্রত নন এই মোটা মানুষেরাও। তার উপরে খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টিভি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেদ ঝরিয়ে রোগা হন। না হলেই যে বিপদ। ওত পেতে রয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত।
মোটা হওয়া সত্যিই কি এতটা ভয়ঙ্কর?
অতি পরিচিত এই হুঁশিয়ারি কিন্তু মানতে রাজি নন অনেক বিশেষজ্ঞই। উল্টে বিভিন্ন রোগের সঙ্গে যুঝতে রোগার চেয়ে মোটারাই অনেক বেশি সুবিধা পান বলে মনে করছেন তাঁরা।
যেমন, কার্ল লেভির কথাই ধরা যাক। নিউ অর্লিয়েন্সের জন অখসনার হার্ট অ্যান্ড ভাস্কুলার ইনস্টিটিউটের মেডিক্যাল ডিরেক্টর কার্ল ২০০২ সাল থেকে হৃদ্রোগীদের পরীক্ষা করে আসছেন। তিনি দেখেছেন, এক জন স্থূলকায় ব্যক্তি দীর্ঘস্থায়ী অসুখের শিকার হলেও, সেই একই অসুখে আক্রান্ত রুগ্ন চেহারার কোনও রোগীর তুলনায় অনেক বেশি দিন বাঁচেন। কার্ল জানিয়েছেন, তাঁর গবেষণার ফল এতটাই অন্য রকম ছিল যে, প্রায় এক বছর ধরে অনেকের দোরে দোরে ঘুরলেও কোনও বিজ্ঞান-পত্রিকাই তাঁর গবেষণাপত্র ছাপাতে রাজি হয়নি।
এর পর কেটে গিয়েছে বহু বছর। যত সময় গিয়েছে, বিভিন্ন বিজ্ঞানীর গবেষণার ফল কার্ল লেভির গবেষণার সঙ্গে আশ্চর্য রকম ভাবে মিলে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এর নাম দিয়েছেন ‘ওবেসিটি প্যারাডক্স’।
তবে এর কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজি’র অন্যতম ডিরেক্টর গ্রেগ ফনারো জানাচ্ছেন, কোনও দীর্ঘস্থায়ী অসুখের সঙ্গে যুঝতে অতিরিক্ত শক্তি লাগে। মোটা ব্যক্তিরা বাড়তি ক্যালোরি পান তাঁদের দেহে জমে থাকা মেদ থেকে। ফলে তাঁরা রোগের সঙ্গে ভাল ভাবে যুঝতে পারলেও সাধারণ চেহারার মেদহীন মানুষ তা পারেন না। রোগের সঙ্গে যুঝতেই ফুরিয়ে যায় তাঁদের দেহের সব শক্তি। ফলে, দেখা যায় তাঁরা অপুষ্টিতে ভুগছেন।
নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেনবার্গ স্কুল অফ মেডিসিনের গবেষক মার্সিডেস কার্নেথন জানালেন, স্থূল মানুষদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে। কিন্তু রোগাদেরও কেন এই ধরনের ডায়াবেটিস হয় তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন কার্নেথন। গবেষণার ফল দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছেন তিনি। দেখলেন, শুধু এই রোগ হওয়াই নয়, টাইপ-২ ডায়াবেটিসে তাঁদের মৃত্যুহারও মোটাদের তুলনায় দ্বিগুণ।
প্রায় ১১ হাজার মানুষের উপর এই ‘ওবেসিটি প্যারাডক্স’ নিয়ে কয়েক যুগ ধরে গবেষণা চালিয়েছেন কানাডার এক দল বিজ্ঞানী। ২০০৭ সালে তাঁদের গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। তাতেও জানা যায়, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, কিডনির রোগ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মোটা মানুষদের তুলনায় রোগাদের মৃত্যুহার অনেকটাই বেশি।
তবে এত দিন যে মোটা হওয়ার কুফল নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে আসতেন, তার সব কিছুই কি ভুল?
এপিডেমিওলজিস্ট ক্যাথরিন ফ্লেগাল জানাচ্ছেন, উচ্চতা আর ওজনের অনুপাত করে পাওয়া যায় বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই)। এটি ৩৫-এর উপরে থাকলে তাকে অতিরিক্ত মোটা আর ১৮.৫-এর নীচে থাকলে তাকে অতিরিক্ত রোগা (আন্ডার ওয়েট) বলা হয়। ফ্লেগালের মতে, “এর মাঝে থাকা লোকেরাই রোগের সঙ্গে অনেক বেশি যুঝতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হয় অতিরিক্ত মোটা আর বেশি রোগাদের নিয়ে। এই দু’ ক্ষেত্রেই রোগের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়।”
এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায় জানালেন, স্থূলতা মূলত দু’ধরনের হয়। জিনগত কারণে কিছু মানুষ জন্ম থেকেই স্থুল। অনেকে আবার অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস আর অসংযমী জীবনযাপনের কারণে স্থূলতার শিকার। সতীনাথবাবুর বক্তব্য, “বছরের পর বছর ধরে দুর্ভিক্ষ, মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ায় ভারত আর আফ্রিকার মানুষের লিভার আর মেদ কোষের জিনে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এই সব অঞ্চলে মানুষের জিনে খাবার সঞ্চয় করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়ে গিয়েছে।” এখন অর্থনীতি আর প্রযুক্তির উন্নতিতে খাবারের অভাব নেই। এক দিকে বেশি খাবার, অন্য দিকে শরীরচর্চা না করার অভ্যাস এই দু’টো কারণে যে সব মানুষ মোটা হচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শরীরে একটা বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ঠিক এই কারণেই ভারত আর আফ্রিকার মানুষের মধ্যে মোটা হওয়া এবং সেই সঙ্গে ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। তুলনায় রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম।
সতীনাথবাবুর মতে, “যাঁরা জিনগত কারণে জন্ম থেকেই মোটা, তাঁদের অতটা চিন্তার কারণ নেই। কারণ তাঁরা মোটা হয়েও শারীরিক ভাবে অনেকটাই সুস্থ।” এঁদের ক্ষেত্রে মেদ শুধু পেট বা লিভারে জমা হয় না। অন্য দিকে, যাঁরা অতিরিক্ত চর্বি, তেল-মশলা জাতীয় খাবার খেয়ে মোটা হয়েছেন, তাঁদের পেট আর লিভারে মেদ জমার হার অনেক বেশি। আর এই ধরনের মেদ বা সঞ্চিত ফ্যাটে বিশেষ ধরনের কিছু জিন থাকে, যা এঁদের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয় অনেকটাই। পাশাপাশি, জোর করে অতিরিক্ত রোগা হলেও মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায় বলে জানালেন সতীনাথবাবু। তাই মোটা বা রোগা নয়, সুস্থ থাকাটাই অনেক বেশি জরুরি বলে মনে করছেন তিনি।
প্রায় একই মত কার্ল লেভিরও। তিনি জানাচ্ছেন, কেউ রোগা হলেই যে সুস্থ হবে, এই চলতি ধারণাটা সব সময় ঠিক নয়। রোগা বা মোটা নয়, বরং কোনও ব্যক্তি শারীরিক ভাবে কতটা সক্ষম, তিনি নিয়মিত শরীরচর্চা করেন কি না, সেটাই বেশি জরুরি। এ ক্ষেত্রে, ‘এরোবিকস’ বেশ উপযোগী। দ্রুত ওজন না কমলেও, লিভারে মেদ কমাতে এটি বেশ সাহায্য করে।
তাই আর শুধু সাইজ জিরো নিয়ে লাফালাফি নয়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, “শরীর থেকে কতটা ঘাম ঝরাতে পারেন, নজর দিন সে দিকে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.