|
|
|
|
কাঠগড়ায় স্বাস্থ্য দফতর |
অনাবাসী ব্যবসায়ীর দান প্রত্যাখ্যান হাসপাতালের |
অনির্বাণ রায় • জলপাইগুড়ি |
হাতে পেয়েও তিন তিনটি ডায়ালিসিস যন্ত্র পায়ে ঠেললেন এক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের এই সিদ্ধান্তে হতবাক অনাবাসী বাঙালি ব্যবসায়ী অলক বসু। তাঁর এক আত্মীয় ওই হাসপাতালেই কিডনির অসুখ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ডায়ালিসিস যন্ত্র না থাকায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি। তাঁকে পরে অন্যত্র নিয়ে যেতে হয়। তখনই অলকবাবু ঠিক করেন, এই হাসপাতালকেই খুবই ব্যয়বহুল ওই ডায়ালিসিস যন্ত্র তিনিই দান করবেন।
সেই মতো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি জানতে পারেন, একটি নয়, তিনটি ডায়ালিসিস যন্ত্র মিলে একটি ইউনিট তৈরি হয় এবং তার রক্ষণাবেক্ষণও বেশ খরচসাপেক্ষ। এখন কাতারের দোহার প্রবাসী ব্যবসায়ী জলপাইগুড়ির সন্তান অলকবাবু অবশ্য তাতেও রাজি হয়ে যান। প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার তিনটি যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও নেবেন বলে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তখন ফের জানান, ডায়ালিসিস ইউনিট চালু করতে হলে একটি ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ প্রয়োজন। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। তাতেও রাজি হন অলকবাবু।
এই করতে করতেই কেটে যায় বছর খানেক। তারপরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি অলকবাবুকে জানিয়ে দিয়েছে, তাঁর দান তাঁরা নিতে পারবেন না।
কেন? স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “জলপাইগুড়ি হাসপাতালে স্বাস্থ্য দফতর নিজেই ডায়ালিসিস ইউনিট চালু করতে চলেছে। এক হাসপাতালে দু’টি ইউনিট থাকার তো কোনও প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া থাকলেই তো হবে না। তার আনুষঙ্গিক খরচ এবং প্রশিক্ষিত কর্মীও প্রয়োজন। সেটা জোগাড় হবে কোথা থেকে? যন্ত্র নিয়ে সেটা ব্যবহার না করে ফেলে রাখার তো কোনও অর্থ নেই। তাই স্বাস্থ্য দফতর ওই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি।”
এই কথা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে যান অলকবাবু। জলপাইগুড়ির পুরাতন পুলিশ লাইন এলাকাতে তাঁদের পৈতৃক ভিটে। স্থানীয় জেলা স্কুলেই পড়াশোনা। তাই এই শহরের প্রতি তাঁর টান রয়েছে বরাবর।
অলকবাবুর প্রতিক্রিয়া, “স্বাস্থ্য দফতরের প্রাথমিক উত্তরে ভেবেছিলাম, তাঁরা রাজি থাকবেন। তাই ডায়ালিসিস যন্ত্র সরবরাহকারী সংস্থার সঙ্গেও ইতিমধ্যে কথাবার্তাও চূড়ান্ত করে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন ওঁদের অনীহায় হতাশ লাগছে।”
আর সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে, অসংখ্য কিডনি রোগীকে যেখানে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে ঘটিবাটি বিক্রি করে ব্যয়বহুল হাসপাতালে ছুটতে হয়, সেখানে জেলা হাসপাতালে দান করতে গিয়েও কেন প্রত্যাখ্যাত হলেন অলকবাবু?
প্রশ্ন উঠেছে, রাজ্য জুড়ে যখন স্বাস্থ্য বিভাগে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে পরিষেবা চলছে, সেই সময় অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ডায়ালিসিস ইউনিটের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেওয়ার লিখিত অঙ্গীকার করলেও কেন সেই প্রস্তাবে রাজি হল না স্বাস্থ্য দফতর? শুধু তাই নয়, তাঁর প্রস্তাবটি নিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলল নানা টালবাহানাও। তারপরে খারিজ করে দেওয়া হল তাঁর প্রস্তাব। যে কারণে বিরক্ত অলকবাবুকে বলতে হচ্ছে, “যন্ত্রগুলি কেনার কথা যখন হয়েই গিয়েছে, তখন নিজেকেই কিছু করতে হবে। সেগুলো অন্য কোনও বেসরকারি সংস্থাকেও দিয়ে দিতে পারি।”
অথচ কলকাতার মাত্র তিনটি মেডিক্যাল কলেজ এসএসকেএম, নীলরতন সরকার এবং আরজিকর হাসপাতালে এখন ডায়ালিসিস ইউনিট রয়েছে। এ ছাড়া ডায়ালিসিস হয় শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে।
কলকাতার বাইরে সরকারি তরফে ডায়ালিসিস ইউনিট আছে বর্ধমান, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে এক একটি যন্ত্রে দিনে চার থেকে পাঁচ জনের বেশি ডায়ালিসিস হয় না। অথচ রোগীর চাপ বিপুল। এই পরিস্থিতিতে ওই যন্ত্রগুলি প্রত্যাখ্যান না করে কি অন্য হাসপাতালে তা গ্রহণ করতে পারত না স্বাস্থ্য দফতর?
এক স্বাস্থ্যকর্তা জবাব দেন, “মোট ৩৪টা হাসপাতালে নতুন করে ডায়ালিসিস ইউনিট চালু করা হবে। এর পরে আবার বাড়তি যন্ত্র বসানোর মতো জায়গা থাকবে না। আমরাও অপারগ।”
এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক রাজেন্দ্রনাথ পান্ডে অবশ্য বলেছেন, “এমন সৎ উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান না করে বিকল্প ব্যবস্থা করা যেতে পারে।” সেটা কী? তিনি বলেন, “সরকারি উদ্যোগেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত কোনও হাসপাতালে যন্ত্রগুলি বসানোর
ব্যবস্থা করা যায়। সেখানে সরকারি হাসপাতাল থেকেও রোগী পাঠানো হবে। তারা নিখরচায় এই পরিষেবা দেবে। এতে প্রত্যাখ্যানও হবে না, আবার গরিব মানুষ পরিষেবাও পাবেন।”
এই প্রস্তাব স্বাস্থ্যকর্তারা কতটা মানেন, এখন সেটাই দেখার।
|
|
|
|
|
|