|
|
|
|
সন্তানের ‘হাসি’ ফিরতে পারে সহজেই |
সোমা মুখোপাধ্যায় • কলকাতা |
ঘটনাটা শুনিয়েছিলেন কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের শিশু চিকিৎসক। পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি স্কুলের পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত আর্জি জানিয়েছিলেন এক ছাত্রের বিরুদ্ধে। বক্তব্য, ওই ছাত্রকে অবিলম্বে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। নিজেদের সন্তানকে তাঁরা ওই ছাত্রের সঙ্গে পড়তে দিতে রাজি নন।
কী ওই ছাত্রের অপরাধ? তার ঠোঁটের উপরের অংশ অনেকখানি কাটা এবং নাক ও ঠোঁটের মাঝখানে বড়সড় ফাঁক। সব মিলিয়ে মুখটি বীভৎস আকার নিয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে তাড়িয়ে না দিলেও সহপাঠীদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে স্কুলে আসা বন্ধ করে দেয় ছেলেটি। তার বাবা-মাও তাকে ঘরে লুকিয়ে রাখতে পারলেই যেন বেঁচে যান। ওই চিকিৎসকের আক্ষেপ, অস্ত্রোপচার করালে ছেলে সুস্থ হয়ে উঠবে, এটা বিশ্বাস করতে পারেননি বলেই বাবা-মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসেননি।
২০১১-র ৭ জুলাই। হলিউডে পিঙ্কি। |
অথচ ঠিক এই সমস্যার সুরাহার জন্যই সরকারি-বেসরকারি তরফে নিখরচায় অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা রয়েছে। অস্ত্রোপচারের পরে সুস্থ জীবনে ফেরার সম্ভাবনাও প্রায় ষোলো আনা। তবু বহু ‘গন্না কাটা’ শিশুর বাবা-মায়েরাই তাঁদের সন্তানদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে রাজি নন। ফলে পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও ‘ক্লেফট প্যালেট’ শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনাটা এ রাজ্যের চিকিৎসকদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
কাকে বলে ‘ক্লেফট প্যালেট’? চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সাধারণ ভাবে গর্ভধারণের চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে মুখের অংশ তৈরি হয়। এই সময়ে ধাপে ধাপে তৈরি হয় ঠোঁট ও টাকরা। বেশ কিছু ক্ষেত্রে টাকরা সঠিক ভাবে না জুড়ে নাকের ডগা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। দু’দিকের ঠোঁট ঠিক ভাবে না জুড়লে নাক ও ঠোঁটের মধ্যে একটা বিশাল ফাঁক তৈরি হয়, যা ক্রমশ বীভৎস আকার ধারণ করে। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন গঠনগত প্রক্রিয়া সঠিক ভাবে না হলে এই ধরনের বিকৃতি নিয়ে শিশু জন্ম নিতে পারে। একেই ‘ক্লেফট প্যালেট’ বলা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিকৃতি শুধু যে মুখের তা নয়, এ থেকে অন্য বিপদও হতে পারে। এই ধরনের শিশু জন্মানোর পর থেকেই আর পাঁচটি সদ্যোজাত শিশুর মতো মায়ের দুধ পান করতে পারে না। কারণ, খাবার তার নাকের মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারে না। খেতে পারে না, হাসতেও পারে না।
এ দেশের শিশুরা মুখের যে ধরনের বিকৃতি নিয়ে জন্মায়, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যা ক্লেফট প্যালেটেরই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে প্রতি ৫০০ শিশুর মধ্যে একটির এই অসম্পূর্ণতা থাকে। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই গ্রামের এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের। এই কারণেই অপুষ্টির সঙ্গে এর একটা সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এ রাজ্যে এক শিশু, অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে। |
কেন এমন সমস্যা হয়? শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “কারণটা মূলত জিনঘটিত। তার পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় মা বিশেষ কোনও ওষুধ খেলে বা মায়ের ভাইরাল সংক্রমণ হলে এমন ঘটতে পারে। সম্ভবত অপুষ্টিও এর একটা কারণ। তবে সেটা প্রমাণিত নয়।” ম্যাক্সিলো ফেসিয়াল সার্জন কমলেশ কোঠারি এ প্রসঙ্গে বলেন, “গ্রামাঞ্চলে ছোট থেকে মেয়েদের পুষ্টির দিকে নজর রাখা হয় না। ফলে পুষ্টির অভাবেই বহু সময়ে গর্ভস্থ শিশু এমন বিকৃতি নিয়ে তৈরি হতে থাকে। বহু সময়েই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন বি পাওয়া যায় না। তাই সমস্যা আরও জটিল আকার নেয়।” ভারতে ১০ লক্ষেরও বেশি শিশু এই সমস্যা নিয়ে রয়েছে বলে জানান তিনি।
এর একমাত্র চিকিৎসা অস্ত্রোপচার। জন্মের পর-পরই বা শৈশবেই অস্ত্রোপচার জরুরি। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের উদ্যোগে জেলাগুলিতে নিয়মিত এই ধরনের অস্ত্রোপচার হয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে অস্ত্রোপচার হয় কলকাতার হাসপাতালগুলিতেও। যদিও চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, নিখরচায় অস্ত্রোপচারের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও স্রেফ সচেতনতার অভাবেই বেশির ভাগ বাবা-মা অস্ত্রোপচার করাতে নিয়ে আসেন না।
শিশু চিকিৎসক পার্থপ্রতিম গুপ্ত বলেন, “জন্মের পরে আট মাসের মধ্যে অস্ত্রোপচার করিয়ে নিলে সবচেয়ে ভাল। কিন্তু এই সচেতনতাটা এখনও গড়ে ওঠেনি। অস্ত্রোপচার করালে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব, বহু বাবা-মা এটা বিশ্বাস করেন না। তাই কখনও কখনও ১৪-১৫ বছরের ছেলেমেয়েরাও আমাদের কাছে আসে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।” স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, “সচেতনতার এই অভাবের কথা বুঝেই জেলা স্তরে এ বিষয়ে প্রচার চালানোর কথা ভাবা হয়েছে। গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রচার চালাবেন।”
অস্কারজয়ী তথ্যচিত্র ‘স্মাইল পিঙ্কি’তে ধরা পড়েছিল এ দেশেরই এক প্রত্যন্ত গ্রামের পাঁচ বছরের মেয়ে পিঙ্কির গল্প। ঠোঁটের মাঝে জন্মগত ফাঁক তাকেও করে তুলেছিল প্রায় অচ্ছুত। স্কুলে যাওয়া ছিল বন্ধ। বাবা-মায়ের সাধ্য ছিল না অস্ত্রোপচারের। শেষে এক সমাজসেবী তাদের গ্রামে হাজির হন। লক্ষ্য, পিঙ্কির মতো ছেলেমেয়েদের খুঁজে বার করে তাদের মুখের হাসি ‘ফিরিয়ে’ দেওয়া। নিখরচায় অস্ত্রোপচারে স্বাভাবিক চেহারা ফিরে পায় পিঙ্কি। আমেরিকায় অস্কার-সন্ধ্যাতেও হাজির ছিল সে। এ রাজ্যের বহু ‘পিঙ্কি’ও হয়তো স্বাভাবিক চেহারায় হেসে ওঠার স্বপ্ন দেখে।
দরকার শুধু বাবা-মায়েদের একটু সাহস আর সচেতনতা।
|
অজ্ঞতায় অপূর্ণ |
• অস্ত্রোপচারে
সেরে যায় সম্পূর্ণ
• নিখরচায় হয় হাসপাতালে
অস্কারজয়ী পিঙ্কির দেশেই
গন্না কাটা
১০ লক্ষ শিশু |
কারণ
• মূলত জিনঘটিত
• গর্ভাবস্থায় খাওয়া কোনও ওষুধ
• গর্ভাবস্থায় ভাইরাসের সংক্রমণ
• সন্দেহের তালিকায় অপুষ্টিও |
|
|
|
|
|
|