|
|
|
|
সরকারি কড়াকড়ি ছিল না তেমন • বৃহস্পতিবার গড় বাঙালি ফের মজেছে বন্ধ-ছুটিতে • তার পাশে এই কাহিনি স্বতন্ত্র |
পাঁচ রাস্তা তিন নদী দুই চাকা এক জেদ |
বরুণ দে • ডেবরা |
বিশ বছরের পুরনো বাহন। উঠোনে নামিয়ে সামনের চাকাটা দু’হাঁটুর মাঝে চেপে ধরে সন্তর্পণে ‘ব্যালান্স’টা ঠিক করার চেষ্টা করতেই ঝড়াং করে উঠল পিছনের কেরিয়ারটা। কবেকার বিএসএ সাইকেল, শব্দ না করে পারে!
সেই শব্দ শুনেই উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী, অষ্টমীদেবী। চোখ রগড়ে শেষ চেষ্টা করেছিলেন, “কী গো, না গেলেই নয়?” স্পোকগুলোয় চোখ বুলিয়ে নেওয়ার ফাঁকে নিজের মনেই মুচকি হেসেছিলেন নারায়ণ বর্মন, “কামাই করলে কি চলে গিন্নি!”
বন্ধ হলেই প্রমাদ গোনেন অষ্টমীদেবী। “কেউ যাক না যাক, ওঁর যাওয়া চাই! তা-ও ওই লজঝড়ে সাইকেলে! হাসপাতাল কি আর এখানে? সাত সমুদ্র পেরিয়ে কোথায় ডেবরা!”
সাত সমুদ্র তেরো নদী না হোক! পূর্ব মেদিনীপুরের প্রান্তিক গ্রাম গোপীনাথপুর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা গ্রামীণ হাসপাতাল পাক্কা ৬৭ কিলোমিটার পথ। পাঁচটা বড় রাস্তা, তিনটে নদী, দু-দু’টো ক্যানাল আর খানপাঁচেক ব্লক ফুঁড়ে তবে পৌঁছনো। সেই হাসপাতালেই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী এই নারায়ণচন্দ্র বর্মন। |
|
সচল চাকা। কাজে চলেছেন নারায়ণ বর্মন। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ |
আল্পস পাহাড় পেরিয়ে ‘ত্যুর দ্য ফ্রাঁস’ না হোক, ৬৭ কিলোমিটার সাইকেলে তাঁর একান্ত ‘ত্যুর দ্য ডেবরা’ অতিক্রম করাই বন্ধের দিনে নারায়ণের অভ্যেস। বন্ধের সকাল আর ওই পুরনো দু’চাকা চড়ে হাসপাতালে আসেননি নারায়ণবাবু, এমনটা মনে করতে পারেন না ডেবরার ব্লক মেডিক্যাল অফিসার রজত পাল। নারায়ণবাবু পৌঁছতেই এ দিন হাসপাতালের বারান্দায় বেরিয়ে এসে রজতবাবু তাই বলতে থাকেন, “আগে একটু জিরিয়ে নিন দেখি।” তারপর নিজের মনেই বিড় বিড় করেন, “ঊনষাট বছর বয়সেও এমন কাজের নেশা, একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন মশাই।” নারায়ণবাবুর সহকর্মীরাও বলছেন, অবসরের সময় যত এগোচ্ছে, ওঁর কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তত যেন বেড়ে যাচ্ছে। আর, হাসপাতালের ফাইল নিয়ে এ ঘর ও ঘর ছোটাছুটির ফাঁকে নারায়ণবাবু বলছেন, “আসলে কী জানেন, আমাদের হাসপাতালে এমনিতেই কর্মী কম। এক জন না এলেই সমস্যা হয়। তাই বন্ধ থাকলে সাইকেলে করেই চলে আসি।”
এমনি দিনেও অফিস যাতায়াতের ঝক্কি নেহাত কম নয়। সকাল ৬টার মধ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমে সাইকেলে রাধামণি। সেখান থেকে বাসে মেচেদা স্টেশন। মেচেদা থেকে ট্রেন ধরে বালিচক। বালিচক থেকে ফের বাসে ডেবরা গ্রামীণ হাসপাতাল। বাড়ি ফিরতে রোজই রাত ৮টা বেজে যায়।
বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকায় একটু আগেই রওনা দিয়েছিলেন নারায়ণবাবু। “ক’টা হবে, এই ধরুন পৌনে পাঁচটা। মোরামের রাস্তাটা ছাড়ালেই বাস যাওয়ার পাকা রাস্তা। সটান গিয়ে উঠেছে রাধামণির বাস স্ট্যান্ডে।” ইচ্ছে ছিল, সকালের প্রথম চায়ে চুমুকটা বাসস্ট্যান্ডে পবনের দোকানেই দেবেন। সে গুড়ে বালি। “গিয়ে দেখি পবন দোকানই খোলেনি।” অতএব মৃদু ক্যাঁচকোঁচ করে বিশ বছরের বুড়ো-সাইকেল আবার রাজ্য সড়কের দিকে ছোটে। “মেচেদা স্টেশনের সেতুটা যখন দেখতে পেলাম তখন সবে সাড়ে সাতটা। বুঝতে পারছিলাম অনেকটা পথ পেরিয়ে গিয়েছি।”
তবে সবাই তো আর ‘নারায়ণবাবু’ নন, পথ যথারীতি শুনশান। দু-একটা বেসরকারি বাস হুস হুস করে তাঁকে পাশ কাটিয়ে যায় বটে, কিন্তু যাত্রী কোথায়? “রাস্তাটা যেন একটু বেশিই খাঁ খাঁ করছিল। গাড়ি-ঘোড়া নেই, আমি একাই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছি। পুরনো একটা গান মনে পড়ছিল।”
বালিচক স্টেশনের কাছে এসে ব্রেক কষা। স্টেশনের চেনা দোকান। “সাইকেল দাঁড় করিয়ে চোঁ-চোঁ করে দু-ভাঁড় চা খেয়ে নিলাম।” তার পর আবার প্যাডেলে পা। ডেবরা হাসপাতালে যখন সাইকেল ঢুকল, কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ন’টা।
হাসপাতালে ৪০টি শয্যায় গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ জন রোগী ভর্তি থাকেন। প্রতিদিন বহির্বিভাগে ভিড় করেন অন্তত শ-দেড়েক রোগী। ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামীণ হাসপাতালে উন্নীত হওয়ার পর এই হাসপাতালকে জেলার ‘ফার্স্ট রেফারেল ইউনিট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। সেই মোতাবেক সবং-পিংলা থেকে কোনও প্রসূতিকে ‘রেফার’ করলে প্রথমে ডেবরা গ্রামীণ হাসপাতালেই ছুটে আসেন তাঁরা। ফলে চাপ যথেষ্ট।
বৃহস্পতিবারের বন্ধে সাত জন চিকিৎসক, ১৮ জন নার্স এবং ১১ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর সকলেই হাসপাতালে এসেছেন। তারই মধ্যে বয়সের ভার আর বিপুল দূরত্ব অগ্রাহ্য করে ছুটে আসা নারায়ণবাবুর জন্য ওঁদের আলাদা শ্রদ্ধা রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্রও বললেন, “নারায়ণবাবুর দৃষ্টান্ত অন্য আরও অনেককে কাজ করার উৎসাহ দেবে।”
নারায়ণচন্দ্র বর্মন নিজে অত শত ভাবেন না। যা করার, নিজের কতর্ব্যবোধেই করেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, “বন্ধ যাতে সফল না-হয়, সে জন্য কম চেষ্টা করেনি সরকার। কিন্তু মানুষ শুনলে তো!”
হাসপাতালে গাছতলায় সারা দিন জিরোয় প্রাচীন সাইকেল। বিকেলে কাঁসাই, সোহাডিহি, গঙ্গাখালির উপর দিয়ে ফের ৬৭ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হবে যে! মলিন চামড়ার সিটে বার দুই চাপড় মেরে নেন নারায়ণবাবু। তার পর বলেন, “চলি, অনেকটা পথ তো!” |
|
|
|
|
|