কাঁধে গ্রামের ৪০টি পরিবারের ভার। উদয়াস্ত দায়িত্ব। কিন্তু বেতন নাস্তি। বিনি পয়সার স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে গ্রাম, থুড়ি দেশ গড়ার এই পরিকল্পনার জনক, গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক।
‘ফল’ও হয়েছে। ‘গ্রাম গঠনে স্বেচ্ছাসেবী চাই’ লিখে স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল এ রাজ্যের কয়েকটি জেলা প্রশাসন। আবেদন যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশ কাজের ধরন এবং প্রাপ্তির অঙ্ক শুনে সরে পড়েছেন। যাঁরা রয়ে গিয়েছেন, এলাকার মানুষ তাঁদের অনেককে এক ডাকে চেনে রাজনৈতিক কর্মী বলে। ফলে, সেবা কতটা ‘নিঃস্বার্থ’ হবে তা নিয়ে ধন্দ থেকেই গিয়েছে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহপ্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্য চিঠি পাঠিয়েছে দিল্লিতে।
পদের পোশাকি নাম ‘ভারত নির্মাণ স্বেচ্ছাসেবক’। এক-একটি গ্রামের ৪০টি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবারকল্যাণে সহায়তা করবেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। পরিবারের সদস্যদের ১০০ দিনের প্রকল্পে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া, রেশন কার্ড তৈরি করিয়ে দেওয়া, ভোট দেওয়ার উপকারিতা বোঝানোর দায়িত্বও স্বেচ্ছাসেবকদের ঘাড়েই। আরও অনেক কিছুর সঙ্গে থাকছে অভাব-অভিযোগ সরকার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ভারও।
এ সব করার জন্য মিলবে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠানো হবে দেশের বিভিন্ন গ্রামে। আগামী পাঁচ
বছরে তার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার খরচ করবে ৮৬ কোটি টাকা। কিন্তু এই বরাদ্দের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের ভাতা বা বেতন বাবদ কিছু ধরা নেই। পুরোটাই প্রশিক্ষণের পরিকাঠামোগত খরচ, আর যাঁরা প্রশিক্ষণ দেবেন তাঁদের যাতায়াত, পারিশ্রমিক। স্বেচ্ছাসেবক হলে বেতন মিলবে না। তবে টি শার্ট (পুরুষ) বা অ্যাপ্রন (মহিলা), একটি করে মোবাইল ফোন আর পরিচয়পত্র পাওয়া যাবে।
বেতন না-ই থাকুক, স্রেফ সেবা করার আনন্দেই কি হওয়া যেতে পারে স্বেচ্ছাসেবক? ‘উঁহু’, বলছে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। তাদের শর্তবয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। নিদেনপক্ষে মাধ্যমিক পাশ হওয়া চাই। আবার কোনও এলাকায় এই কাজে আগ্রহীদের মধ্যে মহিলা, আদিবাসী, অনগ্রসর, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আনুপাতিক অংশগ্রহণ থাকতে হবে।
এত শর্ত পেরিয়ে যাঁদের বাছা হবে, বাড়িতে খেয়ে বনের নীলগাই চরাতে তাঁরা রাজি হবেন কি না, বুঝতে পারছেন না রাজ্য পঞ্চায়েত দফতরের কর্তারা। তাঁদের অনেকের কথায়, “যে পরিমাণ কাজ করার কথা, তা সামলাতে ওই স্বেচ্ছাসেবকদের দিনে ১৮-১৯ ঘণ্টা নাগাড়ে খাটতে হবে। বিনা পয়সার কর্মীদের থেকে যা চাওয়াটাই অসম্ভব। কেউ যদি সব জেনেও কাজটা করতে চান, উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থাকবে।”
এমন সন্দেহ যে অমূলক নয়, প্রমাণও মিলেছে। রাজ্য প্রশাসনের তরফে স্বেচ্ছাসেবক চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পরে বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলে বহু আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। কিন্তু কাজের রকম-সকম শুনে ভিড় পাতলা হয়ে গিয়েছে। শালবনির যুগ্ম বিডিও প্রবীর শিট জানান, তাঁর ব্লকে
সাড়ে ৪০০ আবেদন জমা পড়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত টিকে থাকা আগ্রহীর সংখ্যা হাতেগোনা। যাঁরা থেকে গিয়েছেন, তাঁরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
ফলে, বিনা পয়সার স্বেচ্ছাসেবী নামিয়ে কার্যত রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতেই পঞ্চায়েত স্তরের দায়দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। বাঁকুড়ার সারেঙ্গা ব্লকের এক অফিসারের পর্যবেক্ষণ, “সরকারি পরিচিতি নিয়ে অবাধে তোলাবাজি করা যাবে ভেবে অনেকে স্বেচ্ছাসেবী হতে চাইছে।” পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার এক পঞ্চায়েত প্রধান সিপিএমের আদিত্য সাহার উপলব্ধি, “ভারত নির্মাণ স্বেচ্ছাসেবক চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে লাভ হয়নি। যা করার রাজনৈতিক কর্মীদেরই করতে হবে।”
তা হলে কেন্দ্র এমন পরিকল্পনা করল কেন?
প্রকল্পের নির্দেশিকায় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক বলেছে, ২০১০ সালে মন্ত্রী জয়রাম রমেশ ‘উপলব্ধি’ করেন যে, গ্রামীণ ভারতের উন্নতিকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প সম্পর্কে সচিব স্তরের আধিকারিকদের অনেকেরই ধারণা নেই। কেন্দ্রীয় সরকার গ্রামোন্নয়নে বছরে ৮ লক্ষ কোটিরও বেশি খরচ করে। কিন্তু সরকারি আধিকারিকদের ‘অজ্ঞতায়’ গ্রামীণ জীবনযাত্রার উন্নতি হয় না। সেই ‘ফাঁক ভরাট’ করতেই প্রয়োজন ‘নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবী’।
গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব নীতিন চন্দ্রের দাবি, “অন্ধ্রে এই প্রকল্পে অত্যন্ত ভাল কাজ হচ্ছে। অন্যত্রও ভাল কাজ হবে।” অন্ধ্রপ্রদেশে প্রকল্পটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তা বিকাশ রাজ কিন্তু বলেছেন, “গ্রামাঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করতে গিয়ে নতুন বিপদ দেখা দিয়েছে। সরকারি পরিচয়পত্রের সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে অতি-সক্রিয়তার অভিযোগ উঠছে।”
রাজস্থানে আবার বিপদ এসেছে অন্য দিক থেকে। সেখানকার প্রকল্প আধিকারিক পুরুষোত্তম অগ্রবাল বলেন, “রাজনৈতিক লোকজন গ্রামে গ্রামে গিয়ে সরকারি পরিচয়পত্র দেখিয়ে পরিষেবা কর আদায় করছে বলে শোনা যাচ্ছে।”
ভারত নির্মাণের কাঁচামালে ভেজাল মেশার ঝুঁকি থাকছেই। |