|
|
|
|
তিন তলা সমান বিনায়কের গায়ে ৬০ কেজির গয়না |
তীর্থ আচার্য • কলকাতা |
মুম্বই কাঁপছে। অপেক্ষা শেষের উত্তেজনায়।
মীরা রোড থেকে আন্ধেরি-ওরলি হয়ে কোলাবা। মাহিম থেকে মাটুঙ্গা, বান্দ্রা থেকে বোরিভিলি— মুম্বই জুড়ে অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। তিনি এসেছেন। ‘মুম্বইয়ের রাজা’।
রাজাই বটে! গণেশ-উৎসবে সামিল না-হলে বোঝা যায় না মুম্বই কেন ভারতের বাণিজ্য-নগরী। বোঝা যায় না বিনায়ক ঠিক কতটা বিত্তবান!
কলকাতার দুর্গোৎসবে বাজেট-প্রতিযোগিতার পাশে মুম্বইয়ের গণপতি বাপ্পাকে রেখে দেখুন! তফাৎটা বুঝতে পারবেন!
অ্যান্টপ হিল এলাকার কিংস সার্কেলের জি এস বি স্পোর্টস ক্লাবের সেবা মণ্ডলম-এর পুজোর কথাই ধরা যাক। এই পুজো ‘স্বর্ণ গণেশপূজা’ নামে পরিচিত। কেন ? গত বছর এই পুজোয় গণপতি বাপ্পা-র পায়ে প্রণামী হিসেবে জমা পড়েছিল ১৫ কোটি টাকার স্বর্ণালঙ্কার! এ বছর ৩৪ ফুট উঁচু বিনায়ক মূর্তি সাজানো হয়েছে ৬০ কেজি সোনার গয়নায়! এ বছর প্রতিমা-মণ্ডপ-আলোর জন্য বিমাই করা হয়েছে ২২৪ কোটি টাকার!
এবং এখানেই গল্পের শুরু। ১৮৯৪ সালে ‘মরাঠি মানুষ’-এর আত্মমর্যাদা বাড়ানোর লক্ষ্যে, ‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার’ স্লোগান দিয়ে বালগঙ্গাধর টিলক শুরু করেছিলেন এই গণেশপুজো। আজ তা মহারাষ্ট্রের সবথেকে বড় উৎসব। বড় পুজোগুলোর মধ্যে পরস্পরকে হারানোর প্রাণাম্ত প্রতিযোগিতা।
‘খেতওয়ারিচা গণরাজ’ এ বার ৪০ ফুট! টুয়েলভথ লেন অফ খেতওয়ারির পুজোয় এ বার প্রতিমা সেজেছে শুধু স্বর্ণালঙ্কার নয়, হিরে দিয়ে! ১৯৫৯ সালে পত্তন হওয়া এই পুজো প্রথম দিকে এক টাকা করে চাঁদা তুলত। এখন এর বাজেট কয়েক কোটি টাকা! সেবামণ্ডলমের পুজো আরও পুরনো। সারস্বত ব্রাহ্মণ সমিতির উদ্যোগে ১৯৫৪ সালে কর্নাটকে প্রথম এই পুজো হয়। তার পরই মুম্বইয়ে। নিরাপত্তার জন্য তৈরি করতে হয়েছে অস্থায়ী থানা, দশ দিনের জন্য। ১৯-২৯ সেপ্টেম্বর, ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী থেকে শুরু হয়ে গণপতি-উৎসব শেষ হয় শুক্লা চতুদর্শীতে। |
|
‘লালবাগুচা রাজা’ স্বর্ণগণেশ। —নিজস্ব চিত্র |
মুম্বইয়ের সবথেকে জনপ্রিয় গণেশ, ‘লালবাগুচা রাজা’। সর্বজনিক গণেশোৎসব মণ্ডলম-এর বিনায়ক-বন্দনার সূচনা ১৯৩৪ সালে। লাল ধুতি-উত্তরীয় এবং লাল চন্দনের টিকা পরিয়ে প্রথমে হয় ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠম’। এর পর ‘সোদাশোউপচারো’। অর্থাৎ ষোড়শ উপচারে ভগবানকে ‘শ্রদ্ধাজ্ঞাপনম’। ২১টি নারকোল, ২১টি মোতিচুর মানে মোদক, ২১টি দূর্বা ঘাস, বিপুল পরিমাণ গুড়-মিছরি, রক্ত-লাল ফুল, ত্রিপত্র, রক্ত-চন্দন দিয়ে সাজানো হয় ‘রাজা’কে।
প্রতিদিন গড়ে দেড় লক্ষ মানুষ প্রতিমা দর্শন করেন। দু’টি লাইন করা হয়। একটি লাইনে দশ মিটার দূর থেকে ‘বাপ্পা’কে দর্শন। অন্যটি ‘নভস’, যাঁরা সরাসরি ‘লালবাগুচা রাজা’র পায়ে পুজো দেবেন। ‘নভস’ পথে মণ্ডপে পৌঁছতে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা লাগে। পুরো পথটাই অবশ্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এই ‘নভস’-পথেই পুজো দিতে আসেন অমিতাভ বচ্চন, লতা মঙ্গেশকর থেকে সচিন তেন্ডুলকররা। ‘রাজা’র পায়ে তাঁরা কী অর্ঘ্য দেন, তা অবশ্য আমজনতা জানতে পারে না।
শুধু মুম্বইতেই ছোট-মেজো-বড় মিলিয়ে কমবেশি তিন লক্ষ প্রতিমা! জিতেন্দ্র থেকে নানা পটেকর থেকে লতা মঙ্গেশকর বাড়িতে প্রতিমা এনে দশ দিন ধরে সমস্ত আচার মেনে পুজো করেন। শুধু ‘হুজ হু’ নন, পিছিয়ে থাকেন না প্রান্তবাসীরাও। ধরা যাক, ধারাভি বস্তি। এই দশটা দিন সে-ও ভাবে, ‘আমি কি নিছক বিশ্বের বৃহত্তম বস্তির বাসিন্দা?’ আত্মপরিচয় উদ্ধারের হাতিয়ার হয় গণপতি বাপ্পা। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতারও অভাব হয় না। কারণ, ধারাভিতে যে অনেক ভোট! শুধু কংগ্রেস-শিবসেনা-বিজেপি-এনসিপি নেতারাই নন! বহু বড় বাজেটের পুজোর পিছনে থাকেন এক-এক জন ডন। আশির দশক থেকে ডনদের এই পূজা-পৃষ্ঠপোষণার শুরু। তখন মুম্বই দেখেছে বিসর্জনের দিন হলুদ সিল্কের লুঙ্গি-পাঞ্জাবি আর গলায়-হাতে লক্ষ লক্ষ টাকার গয়না পরা বরদারাজন মুদালিয়রকে, ট্রাকের উপর। ট্রলার-বাহন গণপতির চেয়ে মানুষ বরদারাজনকে বেশি প্রণাম জানিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে দেখেছে অরুণ গাউলিকে। পুজো মণ্ডপে, রাস্তায় ট্রাকের ওপর। সাদা কুর্তা-পাজামা পরা অরুণ মানুষের ‘অভিবাদন’ গ্রহণ করছেন! ‘ডন’ বা ‘অগ্নিপথে’র মতো ছবিতে গণেশ-উৎসবের দৃশ্য তাই এত গুরুত্বপূর্ণ!
গল্পের শেষ হোক, প্রভাদেবীর সিদ্ধি বিনায়কের পূজা-অর্চনা দিয়ে।
বৃহত্তর কলকাতার সব ক’টা মন্দির মিলিয়েও এত জাঁকজমক-ভিড় হয় না, যা হয় সিদ্ধি বিনায়কে। মুম্বইকররা মানেন, সিদ্ধি বিনায়ক-এর জন্যই মুম্বই দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। সাধে কি আর গায়ক অভিজিৎ এই প্রতিবেদককে সখেদে বলেছিলেন: “কলকাতা পুজোটাও ভাল ভাবে করতে পারে না। থিম থিম করে মাথা খুঁড়ে মরে!” |
|
|
|
|
|