|
|
|
|
কফির কেরামতিতেই পাল্টাচ্ছে সময়ের স্বাদ |
অর্পিতা মজুমদার • দুর্গাপুর |
কলকাতা শহর মগজের চর্চা করত কফি হাউসে বসে। এক সময়ে।
প্যারিসের কাফেতে ধোঁয়া উড়িয়ে তাবৎ চালু চিন্তা ওলোটপালট করে দিতেন, প্রেমও করতেন জ্যঁ পল সার্ত্রে এবং সিমোন দ্য বোভোয়া।
সে দিন বিগত।
এখন কলকাতা থেকে দুর্গাপুর কফির স্বাদ বদলেছে। কফি আর চিন্তা-আড্ডার অনুষঙ্গ মাত্র নয়। বরং শুধু নানা স্বাদের কফি চাখতেই শহরের নামী কাফেতে ভিড় ঘনাচ্ছে সন্ধ্যায়। দামি পারফিউম ম্লান করে টেবিল থেকে টেবিলে ছড়াচ্ছে উষ্ণ-শীতল ক্যাফিনের খুশবু।
কিন্তু কফি বলতে বাঙালি বোঝে কী?
ছাপোষা ভেতো মধ্যবিত্তের ঘরে শীতসন্ধ্যায় কফি বলতে গরম দুধের পেয়ালায় ঘন বাদামি গুঁড়ো ঢেলে চিনি দিয়ে ঘেঁটে দেওয়া ছাড়া আর কী? দুধ ছাড়া কালো কফিও ঢুকে পড়েছে কিছু ঘরে, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে যার পোশাকি নাম ছিল ‘ইনফিউশন’। ব্যস! এই-ই। কিন্তু কফি বলতে যে আরও অনেক কিছু, তা মালুম হল সিটি সেন্টারের দু’টি শপিং মলে চলতে থাকা কফি উৎসবে ঢুঁ মেরে।
যে সংস্থাটি উৎসবের আয়োজন করেছে, তাদের কর্মীরাই মেলে ধরলেন রকমারি কফি-নামা। যার শুরুটাই আবার কফি চাষ দিয়ে। জানা গেল, এ দেশে কফির চাষ হয় কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা আর উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। পঞ্চদশ শতক বা তারও আগে কফি গাছ মিলত শুধু ইয়েমেন আর আরবে। কফি যাতে আফ্রিকা ও আরবের গণ্ডি ছাড়িয়ে অন্যত্র না যায়, তার জন্য আরবীয়রা দেশের বাইরে চারা বা বীজ নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছিল।
কিন্তু সেই অপরূপ স্বাদ-গন্ধকে শেষমেশ সীমানার চৌহদ্দিতে আটকে রাখা যায়নি। ১৬১৬ সালে ওলন্দাজেরা প্রথম কফি চারা নিয়ে যায় নিজেদের দেশ হল্যান্ডে (অধুনা নেদারল্যান্ড)। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে তারাই ভারতের মালাবার এবং ইন্দোনেশিয়ায় কফি চাষ শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যেই ওলন্দাজ উপনিবেশগুলি কফি রফতানির প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকে ব্রাজিল, কিউবা, হাইতিতে ব্যাপক হারে কফি চাষ শুরু হয়। আর এখন এমনই অবস্থা যে, কফি বলতে প্রথমেই ব্রাজিলের নাম চলে আসে। |
|
আপাতত মধ্যবিত্তের চেনা প্যাকেটের বা মোটা কাচের শিশির কফি ছাড়াও অন্তত তিন ধরণের কফি মেলে বাজারে। এক, ডি-ক্যাফাইনেটেড কফি যাতে কিনা কফির নেশার উপাদান ক্যাফাইন, যা অতি ব্যবহারে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, সেটাকেই কৃত্রিম উপায়ে বের করে নেওয়া হয়। এতে কারও একে ‘কফি’ বলতে আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্য নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান তাঁরা এতেই বেশি নিশ্চিন্ত। দুই, অরগ্যানিক কফি যা কিনা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই উৎপাদন করা হয়। ফলে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা কমে। তিন, হাই গ্রোন কফি তুলনামূলক বেশি উচ্চতায় বেড়ে ওঠে গাছ থেকে মেলে বিশেষ সুঘ্রাণের এই কফি। উচ্চতার কারণে গাছের বাড় কম হওয়াতেই ঘ্রাণ যায় পাল্টে। মেজাজও।
এর উপরে আছে কফি বানানোর রকমফের। ফেনায় নকশা তোলা উষ্ণ কাপ্পুচিনো যেমন আছে, পাশেই রয়েছে ক্রিম মেশানো শিরশিরে আইসকফিও। চেনা-অচেনা কত দেশের কত রং, স্বাদ, ভঙ্গি। সুরায় মেশানো কফির কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া হল। খদ্দের টানতে আপাতত উৎসবে আসা সুধীজনকে বিচিত্র কিছু কফি তৈরির কারিকুরিও হাতে-কলমে শিখিয়ে দিচ্ছেন সংস্থার লোকজন। হাতে ধরানো হচ্ছে লিফলেট।
ক্লাস নাইনে পড়া নাতনি ঈশানীকে নিয়ে উৎসবে এসেছিলেন ‘এ’ জোনের কনিষ্ক রোডের বাসিন্দা, পঞ্চাশোর্ধ্ব স্নিগ্ধা পোদ্দার। তাঁর কথায়, “কফি খেলাম, বানানো শিখলামও। তবে আমাদের বাঙালি জিভ আর পেটে এত সইলে হয়!”
তাঁর মা-শাশুড়ি হয়তো কফির এত কেরামতি জানতেন না। কিন্তু নাতনির কাছে আলবাত জলভাত হয়ে যাবে এক দিন।
সময়ের স্বাদ তো এ ভাবেই বদলায়! |
|
|
|
|
|