|
|
|
|
সুখ বনধে, শান্তি কোন্দলে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
কেন্দ্রের ‘জনবিরোধী’ সিদ্ধান্তের বিরোধী দু’পক্ষই। তবু বনধ নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা এড়াতে পারল না সিপিএম এবং তৃণমূল। কেবল ‘সুখে’ বনধের ছুটি কাটালেন নাগরিকদের একাংশ।
ইউপিএ-২ সরকারকে সমর্থন করছেন না, আবার বনধও সমর্থন করেননি তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কর্মনাশা বন্ধের পথে না যেতে অনুরোধও করেছিলেন তিনি। তার পরেও অবশ্য বামপন্থীরা বনধের রাস্তা থেকে সরেননি, যেমন সরেনি বিজেপি। তারই জেরে আসানসোলে বামেদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল তৃণমূল। রাজনীতির কোন্দলেই যে ‘শান্তি’ কারও কারও, তা ফের প্রকাশ্যে এল।
প্রত্যাশিত ভাবে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই মোটামুটি সুনসান ছিল শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা। দুর্গাপুর বা রানিগঞ্জের মতো কিছু এলাকায় আবার মিশ্র প্রভাব পড়েছে। খনি ও দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের মতো ভারী শিল্পে প্রভাব না পড়লেও জনজীবন ছিল কার্যত স্তব্ধ। বেশিরভাগ দোকানপাট বনধ ছিল। হাট-বাজার বসেনি। রাস্তার যানবাহনের দেখা বিশেষ মেলেনি। সকালের দিকে কিছু বাস চললেও মানুষজন কম বেরিয়েছেন। ফলে পরে বাস তুলে নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ স্কুল-কলেজে পঠনপাঠন হয়নি। যদিও সরকারি অফিসে হাজিরা স্বাভাবিক ছিল বলে প্রশাসন সূত্রের খবর।
দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে হাজিরার হার ৮৫ শতাংশ ছিল বলে জানিয়েছেন সংস্থার মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক বিভুরঞ্জন কানুনগো। আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, সেখানে হাজিরার হার ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ। ইসিএলের সদর কার্যালয়-সহ বিভিন্ন এরিয়া অফিস ও খনিগুলিতেও উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল বলে জানা গিয়েছে। বার্নপুরের ইস্কো কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল বলে জানিয়েছেন জনসংযোগ আধিকারিক ভাস্কর কুমার। চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানাতেও উৎপাদন স্বাভাবিক হয়েছে বলে কারখানা সূত্রে জানা গিয়েছে। আসানসোল মহকুমার বিভিন্ন রাজ্য সরকারি দফতরে কর্মী সংখ্যা অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক ছিল বলে দাবি করেছেন ভারপ্রাপ্ত মহকুমাশাসক প্রতুলকুমার ভুঁইয়া। |
একলা চলো রে: অন্য দিন যে ট্রেনে তিলধারণের জায়গা থাকে না, বৃহস্পতিবার সকালে
দুর্গাপুর স্টেশনে সেই ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জারের ছবিটি তুলেছেন বিকাশ মশান। |
এ দিন গণ্ডগোল বাধে সকাল ১০টা নাগাদ। আসানসোলে রবীন্দ্র ভবন লাগোয়া একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সামনে পিকেটিং করছিলেন বনধ সমর্থকেরা। এক দল তৃণমূল সমর্থক এসে বিরোধিতা করলে বচসা বাধে। ঘটনাস্থলে পুলিশ ছিল। তবু তাদের সামনেই দু’পক্ষের হাতাহাতি বেধে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বড় পুলিশ বাহিনী এসে দু’পক্ষকে হটিয়ে দেয়। সিপিএমের আসানসোল জোনাল সম্পাদক পার্থ মুখোপাধ্যায়-সহ তিন বনধ সমর্থককে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। আসানসোলের সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরীর নেতৃত্বে কয়েকশো দলীয় সদস্য-সমর্থক আসানসোল দক্ষিণ থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। ঘন্টাখানেক পরে ধৃতদের ব্যক্তিগত জামিনে ছেড়ে দেয় পুলিশ। পরে হাজারখানেক বাম সমর্থকের একটি মিছিল শহর পরিক্রমা করে।
সাংসদের অভিযোগ, “আমরা শান্তিপূর্ণ পিকেটিং করছিলাম। এক দল তৃণমূল সমর্থক এসে হামলা চালায়। আমাদের দলীয় পতাকা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেয়। কর্মীদের মারধর করে। আমরা প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।” তৃণমূলের জেলা নেতা অভিজিৎ ঘটক অবশ্য পাল্টা বলেন, “ওরা কাজে যোগ দিতে ইচ্ছুক কর্মীদের বাধা দিচ্ছিল। আমরা শুধু তার প্রতিবাদ করেছি।” আসানসোল-দুর্গাপুরের এডিসিপি (সেন্ট্রাল) সুরেশ কুমারের বক্তব্য, অশান্তি রুখতেই তিন জনকে জামিনযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করে পরে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আর কোনও গ্রেফতারির খবর নেই।
এ দিনই ১২ ঘণ্টা ব্যবসা বনধের ডাক দিয়েছিল আসানসোল চেম্বার অফ কমার্স। সংগঠনের সভাপতি সুব্রত দত্তের দাবি, মহকুমার সর্বত্রই বনধ পালন করেছেন ব্যবসায়ীরা। প্রায় ১০ কোটি টাকার লেনদেন হয়নি। সংগঠনের শতাধিক সদস্য-সমর্থক আসানসোল পুরসভার সামনে ধর্নাও দেন। তবে বারাবনিতে বনধের তেমন প্রভাব পড়েনি। যানবাহন না চললেও বাজারহাট, দোকান খোলা ছিল। কোলিয়ারি-সহ বিভিন্ন ছোটখাটো কারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন হয়। এলাকার তৃণমূল বিধায়ক বিধান উপাধ্যায়ের দাবি করেন, নাগরিকেরা বন্ধ উপেক্ষা করেই রাস্তায় নেমেছেন।
রানিগঞ্জের খনি-শিল্পাঞ্চলেও মিশ্র প্রভাব পড়েছে। আসানসোল মিনিবাস অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, সকালের দিকে আসানসোল, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, অন্ডাল ও পান্ডবেশ্বর রুটে কিছু বাস নামলেও যাত্রীর অভাবে বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে সমস্ত কোলিয়ারির উৎপাদন ছিল স্বাভাবিক। রানিগঞ্জ শহর এবং জামুড়িয়ার কেন্দা, খাসকেন্দা, চিচুড়িয়া ও চাকদোলা এলাকায় প্রায় সব স্কুলই খোলা ছিল। তবে শিক্ষকেরা হাজির হলেও চল্লিশ শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী স্কুলে আসেনি। বার্নপুর ত্রিবেণী মোড়ে বিজেপি-র পিকেটিংয়ে তৃণমূল হামলা চালায় বলে অভিযোগ। দলের আসানসোল জেলা কমিটির সম্পাদক পবন সিংহ বলেন, “এক পরিচিত সমাজবিরোধীকে সঙ্গে নিয়ে তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব পিকেটারদের উপর চড়াও হয়। দ্রুত পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে। আমরা হিরাপুর থানায় ওদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি।” যদিও তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। |
একই পথের যাত্রী |
|
|
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দু’জনেই। মোটরবাইকে সওয়ার, হাতে ঝান্ডা, ভাবভঙ্গিও একই রকম। ফারাকের
মধ্যে এক দল বনধের পক্ষে, অন্য দল বিপক্ষে। আসানসোলে শৈলেন সরকারের তোলা ছবি। |
|
দুর্গাপুর শহরে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার খবর নেই। তবে গ্রামাঞ্চলে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। সকালে ২ নম্বর জাতীয় সড়কে গলসির পুরষার কাছে বনধ সমর্থকেরা দুর্গাপুরগামী দক্ষিণবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার একটি বাস আটকান। পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কাঁকসার পানাগড় বাজার ও জাটগোড়িয়ায় তৃণমূল সমর্থকেরা সিপিএমের মিছিলে বাধা দেন বলে অভিযোগ। দোমড়ায় বিকালের দিকে সিপিএমের একটি মিছিলকে ঘিরে সামান্য উত্তেজনা ছড়ায়। অভিযোগ, কাঁকসা-৩ লোকাল কমিটির সদস্য মুক্তি মুখোপাধ্যায়কে বুধবার রাতে মারধর করেন কিছু তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবিতে এ দিন মিছিল বের করে সিপিএম। অশান্তি এড়াতে পুলিশ মিছিল বন্ধের আর্জি জানিয়েছিল। পাশাপাশি দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেফতারের আশ্বাস পেয়ে সিপিএম নিরস্ত হয়।
সকালে দুর্গাপুর স্টেশন লাগোয়া বাসস্ট্যান্ডে কিছু মিনিবাসের দেখা মিলেছিল। কিন্তু তেমন যাত্রী না থাকায় তা সংখ্যায় ছিল কম। বড় বাস প্রায় চোখেই পড়েনি। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বনধের সমর্থন অথবা বিরোধিতায় শহরের কেউ কোথাও পথে নামেনি। সরকারি অফিসে হাজিরা ছিল স্বাভাবিক। কলকারখানাতেও তা-ই। আইএনটিটিইউসি-র জেলা সভাপতি প্রভাত চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বনধের নাম করে শ্রমিকেরা কেউ ঘরে বসে থাকেননি। রোজকার মতো স্বাভাবিক কাজকর্ম করেছেন।”দোকানপাট আংশিক খোলা ছিল। কিন্তু খরিদ্দার তেমন ছিল না। সিটি সেন্টারে শপিং মলগুলি খোলা থাকলেও কর্মীদের অনেকেই কাজে আসেননি। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন মেয়র রথীন রায়ের দাবি, “সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে সাড়া দিয়েছেন। তাই রাস্তাঘাট ছিল সুনসান। কিছু দোকানপাট খোলা থাকলেও কর্মীরা আসেননি। খরিদ্দারেরও দেখা মেলেনি।”
তিন দিন বাস ধর্মঘটের পরে বনধের গেরো কাটছে আজ, শুক্রবার। সপ্তাহ যখন প্রায় শেষ হতে চলেছে, এ বার হয়তো শেষমেশ জনজীবন ‘স্বাভাবিক’ হবে। |
|
|
|
|
|