পরিবারের অমতে প্রেম বা বিবাহ করার অপরাধে আত্মজাকে খুনের একটি ঘটনা বঙ্গবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছে। ঘটনাটি বাস্তবিকই মর্মান্তিক। বিশেষত ঘাতক যখন তাহার নিজের বাবা, দাদা এবং কাকা। বলা হইতেছে, পরিবারের সম্মানরক্ষায় নাকি মেয়েকে এ ভাবে চরম শাস্তি দেওয়া হইয়াছে, যে-সম্মান প্রতিবেশী এক দিনমজুর ছেলের সহিত প্রেম ও পলাতক বিবাহের ফলে ধূলিলুণ্ঠিত। জাতিভেদকণ্টকিত উত্তর ভারতের অনুরূপ ঘটনাগুলির সহিত নদিয়া জেলার নাকাশিপাড়ার অপকাণ্ডটির তুলনাও টানা হইতেছে। নিহত মেয়েটির মা-ও এই সম্মানহানির কথা উল্লেখ করিয়া স্বামী-দেবর-পুত্রকে কন্যাহত্যায় প্ররোচিত করিতেছিলেন, এমন সাক্ষ্যও শুনা যাইতেছে। কিন্তু উত্তর ভারতে জাতপাতের বিচার এবং অস্পৃশ্যতার সামাজিক বৈষম্যের কারণে নিম্নবর্গীয়ের সহিত উচ্চবর্ণীয়ের প্রেম বা বিবাহে যে সামাজিক রক্তচক্ষুর নিষেধ বিদ্যমান, এ ক্ষেত্রে তেমন কোনও ব্যাপার ছিল কি? তাই খুনের কারণ হিসাবে পরিবারের সম্মানরক্ষার অজুহাতটি তত জোরালো নাও হইতে পারে।
অনুমান করা যায়, প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে অবাধ্যতার, পরিবারের মতামত অগ্রাহ্য করার। পরিবারের মতামত মানে অবশ্যই পরিবারের পুরুষদের মতামত কন্যা হিসাবে, জায়া হিসাবে, এমনকী মা হিসাবেও নারীকে যাহা চিরকাল শিরোধার্য করিয়া আসিতে হইয়াছে। সেই মত অমান্য করিলে কখনও অনূঢ়া কন্যার বাড়ির বাহিরে যাওয়া, সামাজিক মেলামেশা করায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কখনও ঘরে বন্ধ করিয়া রাখা হয়। আবার কখনও দূরে কোথাও আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। কখনও বা জোর করিয়া কন্যার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাকে পাত্রস্থ করা হয়। এ ভাবেই বঙ্গীয় সমাজ অবশিষ্ট ভারতীয় সমাজের মতোই পরিবারের মহিলাদের সহিত আচরণ করিয়া থাকে। নারী যদি পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়, তবে তাহাকে মৃত ভাবিতেও পরিবারের আপত্তি নাই। সে যদি আত্মঘাতে না মরে, তবে তাহাকে মারিয়া ফেলিলেই ল্যাঠা চুকিয়া যায়। ইহাই ভারতীয় সামন্ততন্ত্র, এবং পশ্চিমবঙ্গীয় সমাজ এই সামন্ততন্ত্রের নিগঢ় ভাঙিয়া নারীর সমূহ ক্ষমতায়ন ঘটাইয়াছে, ইহা একটি আত্মগর্বী জনশ্রুতিমাত্র। মেয়েদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকিবে, নিজেদের জীবন সম্পর্কে তাহারা নিজেরা সিদ্ধান্ত লইবে ইহা এই সমাজের কাছে অকল্পনীয়। নাকাশিপাড়ার ঘটনায় অবাধ্য মেয়েটির মা নিজে যখন পরিবারের সম্মানহানির অজুহাতে আত্মজাকে মারিয়া ফেলার কথা বলিতেছিলেন, নারী হইয়াও তিনি পরিবারের পুরুষদের ভাষা ও ভাবনারই প্রতিধ্বনি করিতেছিলেন। না করিয়া কি তাঁহার কোনও উপায় ছিল? মেয়ের অবাধ্যতার দায় তো পরিবারের পুরুষরা মায়ের ঘাড়েই চাপায়। তাঁহারই প্রশ্রয়ে মেয়ে পরিবারের সম্মান ধুলায় মিশাইতেছে, এ অভিযোগ ওঠে। মা হইয়াও তিনি পরিবারের কেহ নহেন, বাহিরের লোক। কন্যাসন্তান হইয়াও তাঁহার আত্মজা যেমন পরিবারের বাহিরের, অচিরেই যাহাকে পরিবারের পুরুষদের সিদ্ধান্তে বিবাহে নির্বাসিত করা হইবে। ভারতীয় সামন্ততন্ত্রে পরিবার মানে পরিবারের পুরুষরা। নারী সেখানে বহিরাগত, তাহাকে পুরুষদের অভিপ্রায়ের সহিত মানাইয়া লইতে হইবে, যদি বাঁচিয়া থাকিতে হয়। |