পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যবাসীকে পথে বসাইয়া ছাড়িল। সোমবার হইতে বেসরকারি বাসের ধর্মঘট আরম্ভ হইয়াছে। পরিবহণমন্ত্রী সম্ভবত টের পান নাই, কিন্তু ধর্মঘটের ধাক্কায় শহর কলিকাতার রাজপথেও বাসের সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম কমিয়া গিয়াছে। ফলে, নিত্যযাত্রীরা পথে ঠাঁয় দাঁড়াইয়া আছেন, ক্লান্ত হইলে বসিয়াও পড়িতেছেন। বাসমালিকরা যে দাবিতে ধর্মঘট ডাকিয়াছেন, যুক্তির পরিসরে তাহা প্রত্যাখ্যান করা কঠিন। কিন্তু যুক্তি যেখানে শেষ হয়, সেইখানেই জেদের শুরু। মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার জেদের কারণেই ভারতজোড়া নাম কিনিয়াছেন। তাঁহার জেদ, বাসভাড়া বাড়িবে না। পরিবহণমন্ত্রীও একই ধুয়া ধরিয়াছেন মানুষের কথাও তো ভাবিতে হইবে! সম্ভবত সেই ভাবনার আশীর্বাদেই মানুষ বাসের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়াইয়া থাকিতেছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাক, বাসের ভাড়া না বাড়াইবার ‘জেদ’টি তাঁহার নিজস্ব নহে। তাঁহার পূর্বসূরিরাও পারতপক্ষে ভাড়া বাড়াইবার অনুমতি দিতেন না। জনমোহনের এমন সস্তা পথ আর কয়টাই বা আছে? বর্তমান পরিবহণমন্ত্রীও তাঁহার বাম পূর্বসূরিদের ধারা বজায় রাখিয়াছেন। বেসরকারি বাসের ধর্মঘট থাকিলেই সরকারি বাস নামাইয়া ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’ রাখিবার কথা বলেন। কার্যক্ষেত্রে বামপন্থীরাও পারেন নাই, শ্রীমিত্রও পারেন না। আর, সরকারি বাস চালাইবার জন্য ধর্মঘটের অপেক্ষায় থাকিতে হয় কেন? ভাড়া না বাড়াইবার জেদে ভর্তুকির পরিমাণ মাসে ৪০ কোটি টাকা ছাড়াইয়াছে বলিয়াই কি?
সরকারি বাস ভর্তুকির জ্বালানিতে চলে। প্রকৃতার্থে, চলে না। ভর্তুকির অর্থে কর্মীদের বেতনাদি হয় বটে, বাসের রক্ষণাবেক্ষণাদির জন্য আর পয়সা থাকে না। ফলে, মন্ত্রীর বিশেষ হুকুম না হইলে অধিকাংশ সরকারি বাসই রাস্তায় নামে না। বেসরকারি বাসের ক্ষেত্রে ভর্তুকির ঠেকাটুকুও নাই। বাস পথে নামাইলে লোকসান নিশ্চিত। ফলে, বাসমালিকরা গাড়ি বসাইয়া রাখিবার সিদ্ধান্ত করিতেছেন। কলিকাতা শহরের পরিবহণ ব্যবস্থাও ক্রমে অটো রিকশা নামক যানটির উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িতেছে। যানটি অতি অকুশলী। একটি অটোয় আইনত বড় জোর চার জন (বাস্তবে ছয়-সাত জন) সওয়ারি যাতায়াত করিতে পারেন। সওয়ারি-পিছু রাস্তার মাপ, জ্বালানি খরচ প্রতিটি মাপকাঠিতেই অটোরিকশা গণপরিবহণ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার অযোগ্য। অথচ, পরিবহণ দফতরের নীতিপঙ্গুত্বে এই অটো রিকশাই পশ্চিমবঙ্গের সবেধন গণপরিবহণ হইয়া উঠিতেছে। আর যাঁহাদের সাধ্য আছে, তাঁহারা ব্যক্তিগত গাড়ির দিকে ঝুঁকিতেছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানেন কি, যে শহরে গরিব মানুষও ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ে, সেই শহর প্রকৃত উন্নত নহে; যে শহরে বড়লোকরাও গণপরিবহণ ব্যবহার করিতে পারেন, তাহাই যথার্থ উন্নত শহর? এই হিসাবে কলিকাতা অতি দ্রুত বেগে পিছন দিকে আগাইয়া যাইতেছে। পশ্চিমবঙ্গে অবিলম্বে যথার্থ পরিবহণ নীতি চাই। মুখ্যমন্ত্রীর মর্জি হইলে তবেই বাস-ট্যাক্সির ভাড়া বাড়িবে ইহা পরিবহণ নীতি নহে, ইহা সম্পূর্ণ পরিবহণ ব্যবস্থাটিকে ধ্বংস করিবার অব্যর্থ উপায়। প্রধানমন্ত্রীর সংস্কার-বাসনা যদি অক্ষুণ্ণ থাকে, তবে বিশ্ব বাজারের সহিত সঙ্গতি রাখিয়া দেশে ডিজেলের দাম বাড়িবে-কমিবে। ভাড়া স্থির করিতে মুখ্যমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী থাকিলে ডিজেলের দাম বাড়িলেই পশ্চিমবঙ্গ অচল হইবে। ভাড়া নির্ধারণের জন্য একটি স্থায়ী এবং রাজনীতি-নিরপেক্ষ ব্যবস্থা প্রয়োজন। জ্বালানি এবং অন্যান্য খরচ বিবেচনা করিয়া ন্যায্য ভাড়া স্থির করিতে হইবে। তাহার পূর্বে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিতে হইবে, জোর করিয়া দাম কমাইয়া রাখিবার খেলা বেশি দিন চলে না। বাজার অমোঘ, তাহার শক্তিকে মানিয়া লওয়াই শ্রেয়। এই কথাটি সাধারণ মানুষ বিলক্ষণ বোঝেন, মুখ্যমন্ত্রী নির্ভয়ে থাকুন। চার টাকার পরিবর্তে আট টাকা ভাড়া দিলে যদি প্রতি দিনের হয়রানি এড়ানো সম্ভব হয়, মানুষ সাগ্রহে, সানন্দে সেই বাড়তি ভাড়া দিবেন। মুখ্যমন্ত্রী জেদ ছাড়ুন। মানুষের নাভিশ্বাস উঠিতেছে। |