গোটা হিমালয়ই যেন
ধসে পড়ল মাথায়
দুপুরবেলা বৃষ্টি নামে। বেশ জোরে। বিকেলে থেমে গেলেও অদ্ভুত এক মেঘের ঘনঘটা ছিল বৃহস্পতিবার উখিমঠের আকাশে। নিকষ কালো। অসময়েই অন্ধকার চরাচর। শনশন বইছে এলোমেলো হাওয়া। কেমন এক অজানা আশঙ্কা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল সকলকে। আমরা, এখানকার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের স্কুলের কর্মী-শিক্ষকরা বলাবলি করছিলাম, এ কি কোনও বড় দুর্যোগের পূর্বাভাস?
একঘেয়ে বৃষ্টি নিয়েই শুতে গিয়েছিলাম। অনেক রাতে ধড়মড় করে উঠে পড়লাম এক ভয়ানক আওয়াজে। কান ফাটানো এমন বিকট শব্দ, মনে হচ্ছে গোটা হিমালয়টাই যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে মাথার উপরে। টর্চের আলোয় ঘড়ি বলল রাত প্রায় আড়াইটে। ঘরের আলো জ্বললো না, কারণ বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকারে বুঝতে চেষ্টা করছি, ঠিক কী ঘটছে বাইরে। কোথাও একটা গুরুগম্ভীর শব্দ হয়েই চলেছে। যেন বাঁধ ভেঙে আছড়ে পড়া জলের তোড় বয়ে চলেছে ঘরের বাইরে দিয়ে। কিছু মানুষ ছুটোছুটি করছেন। কেউ কি ডাকলো? অন্ধকারেই হাতড়ে বাইরে এলাম। ভারত সেবাশ্রমের দফতরের ঠিক সামনে ঢালু পাহাড়ি রাস্তা। সেখানে তখন একগলা জল। উল্টো দিকের পাহাড় থেকে যে ভাবে গর্জন করে নেমে আসছে সফেন জলের ধরা, এক ঝলক দেখেই আমার মনে পড়ল নায়াগ্রা-র কথা। দু’দিকে যতদূর চোখ যায় সেই জলের দেওয়াল। জলের সঙ্গে কখনও নেমে আসছে দানবাকার পাথর, গাছের গুঁড়ি, ডালপালা। তার মধ্যেই পাশের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে এনে মাথাগুনতি করা হল সঙ্ঘের কর্মী ও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলিয়ে ২৫ জনকে। কিন্তু তখনও জানি না ঠিক কী ঘটেছে শিবঠাকুরের আপন দেশ এই উখিমঠে।

উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছেন সেনা জওয়ানরা। রুদ্রপ্রয়াগে। ছবি:পি টি আই
শুক্রবারের সকাল। জলের তোড় অনেক কম। কিন্তু কোথায় সেই রাস্তা? সঙ্ঘের দফতর, অতিথি নিবাস ঠিক আছে। ওই যে স্কুলবাড়িও দাড়িয়ে আছে অটুট। কিন্তু আশপাশের স্থানীয় মানুষ-জনেদের যে এত বাড়িঘর ছিল, জমিতে ধাপ কেটে ছিল ধানের চাষ, কোথায় সে সব? মানুষগুলোই বা গেল কোথায়? সব যেন জলের তোড়ে মুছে নেমে গিয়েছে কয়েক হাজার ফুট নীচে দিয়ে বয়ে চলা মন্দাকিনীতে। উল্টো দিকের হোটেল-বাড়িটি অক্ষত আছে, কিন্তু তার ঠিক পিছনেই পিছলে এসে ঝুলছে বিশালাকার এক পাথর, যেন একটা গোটা পাহাড়ই।
বেলা গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ এসে ভিড় জমাতে লাগলেন। কারও স্বজন ভেসে গিয়েছেন চোখের সামনে দিয়ে। কেউ বা নিজে বাঁচলেও খোঁজ পাচ্ছেন না কারও। বুক চাপড়ে কেঁদে চলেছেন গরিব মানুষগুলো। ঘরবাড়ি নেই, আত্মীয়-স্বজনও নিপাত্তা। ভাঙা রাস্তা ধরে কোনও ক্রমে ঘুরে এসে কয়েক জন জানালেন, আধ কিলোমিটার দূরে একফালি সমতল জুড়ে উখিমঠ বাজারের কোনও হদিশ নেই। শ’খানেক দোকানঘর সমেত গোটা এলাকাটিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। তবে কিছুটা ওপরে কয়েকশো বছরের পুরনো মন্দিরটি ছোটখাটো ক্ষয়ক্ষতি সামলে ঠিকই আছে। কেদারনাথ, তুঙ্গনাথ, রুদ্রনাথ, মদমহেশ্বর ও কল্পেশ্বর এই পঞ্চকেদারের বিগ্রহ বছরের ছ’মাস এই মন্দিরেই থাকে। কথিত আছে এখানেই সুর্যপুত্র অনিরুদ্ধের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ঊষার, যাঁর নামে এই উখিমঠ।
প্রশাসন তৎপর। শুক্রবার বেলা গড়াতেই আকাশে কপ্টার। উদ্ধার কাজে নামলেন ইন্দো টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি)-এর জওয়ানরা। তাঁদের কাছেই জানা গেল, বৃহস্পতিবার উখিমঠে যা হয়েছিল তা আদতে ক্লাউডবার্স্ট। অর্থাৎ, অদ্ভুত সেই মেঘপুঞ্জ ভেঙে পড়েই এই ভয়াবহ কাণ্ড। দু’বছর আগে যা লাদাখের লে শহরের বহু জনপদ মুছে দিয়েছিল। উত্তরকাশীতেও একই ঘটনা ঘটেছে গত মাসে। কিন্তু এত ভয়াবহ ছিল না তা।
তিন দিনের তল্লাশিতে একে একে উঠে এল ৭১টি দেহ। সোমবার ফিরে গিয়েছেন আইটিবিপি-র জওয়ানরা। তাঁদের পরিবর্তে এসেছে এনডিআরএফ। কিন্তু মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত বহু মানুষের খোঁজ মিলছে না। মনে করা হচ্ছে, ঘরদোরের সঙ্গে তাঁরাও খরস্রোতা মন্দাকিনীতে পড়ে ভেসে গিয়েছেন।
সঙ্ঘের উখিমঠ শাখার প্রধান সুধীর মহারাজ র্দুযোগের দু’দিন আগেই হরিদ্বারে গিয়েছেন। সেখান থেকে তিনি খবর পাঠালেন, স্কুলের অধ্যক্ষা হিসাবে উখিমঠে ত্রাণ কাজ সমন্বয়ের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। অতিথি নিবাস খুলে দেওয়া হয়েছে ঘরছাড়াদের জন্য। ভাঁড়ারে থাকা চাল-ডাল দিয়ে শুরু চলছে লঙ্গর, রোজ অন্তত ২০০ মানুষ খাওয়াদাওয়া করছেন সেখানে। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় বহুগুণা এসেছিলেন, মঙ্গলবার আসার কথা ছিল সনিয়া গাঁধীরও। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া সে সফর হতে দিল না।
ক্লাস ফোরের ছাত্র ছিল ফুটফুটে শিবম পুষ্পান। নার্সারিতে পড়ত ছোট্ট ছটফটে রাঘব তিওয়ারি। দু’জনের নিথর দেহ উদ্ধার হয়েছে পাথর আর কাদার তাল ছেঁচে। নিখোঁজ এখনও অনেক ছাত্রছাত্রী। এক দিন স্কুল খুলবে, পড়াশোনাও শুরু হবে ফের।
কিন্তু কোনও দিন আর ক্লাসে ফিরবে না শিবম বা রাঘবের মতো বহু মুখ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.