রাজ্য সরকার সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজের কাজ কিছু করতে পারছে না। বামফ্রন্ট জমানার কিছু প্রকল্পকে নতুন বলে চালানো হচ্ছে। আবার বহু প্রকল্পের টাকা সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। সংখ্যালঘু-সহ রাজ্যের পিছিয়ে-পড়া অংশের মানুষের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ‘নেতিবাচক’ মনোভাবই তাদের ঈদের উপহার! ঈদের উৎসবের প্রাক্কালে সংখ্যালঘু-প্রশ্নে মমতা-সরকারকে এই ভাবেই বিঁধলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র।
বস্তুত, সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে যা হচ্ছে, তার বেশির ভাগই ‘ঢক্কানিনাদ’ বলে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের অভিযোগ। দলের পলিটব্যুরো সদস্য সূর্যবাবু রবিবার রীতিমতো তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন সংখ্যালঘুদের কল্যাণমূলক প্রকল্প হিসেবে বাম জমানায় কোন কোন কাজে হাত দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সিংহভাগই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী ভাবে অনাদরে পড়ে রয়েছে।
চার বছর আগের পঞ্চায়েত থেকে গত বছরের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত সংখ্যালঘু সমর্থন ঘুরে গিয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতার দিকেই। ‘প্রতিদান’ হিসেবে ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতাও সংখ্যালঘু উন্নয়নের দিকে বিশেষ ভাবে নজর দিয়েছেন। তার জন্য ক্ষেত্র বিশেষে কেন্দ্রীয় সরকারের শংসাপত্রও পেয়েছেন। বাম শিবিরের ব্যাখ্যায়, আরও একটি পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘু মন ফিরে পাওয়ার তাগিদেই বর্তমান রাজ্য সরকারের ‘ঢক্কানিনাদ’কে নিশানা করতে চাইছেন সূর্যবাবুরা।
রাজ্যের সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত জেলাগুলির জন্য একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় কেন্দ্রীয় সরকার বাড়তি টাকা দিচ্ছে। কিন্তু প্রাক্তন মন্ত্রী সূর্যবাবু বোঝাতে চেয়েছেন, সাচার কমিটির রিপোর্টের পরে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত জেলাগুলির জন্য এমন উদ্যোগ আগেই শুরু হয়েছিল এবং বামফ্রন্ট সরকার তাদের বরাদ্দ টাকার অনুপাতে প্রকল্পও তৈরি করতে পেরেছিল। সূর্যবাবুর কথায়, “এই সরকার বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে যেন, সংখ্যালঘুদের জন্য এঁরা খুব চিন্তিত! সংখ্যালঘু উন্নয়নে কিছু তথ্য বেরিয়েছে, যা আরও স্পষ্ট করা প্রয়োজন। সাচার কমিটির রিপোর্টের পরে কেন্দ্রীয় সরকার একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কিছু অর্থ বরাদ্দ করেছিল। ঠিক হয়েছিল, যেখানে মোট জনসংখ্যার ২০%-এর বেশি মুসলিম থাকেন, সেই জেলায় প্রকল্প চালু হবে। সেইমতো ১২টি জেলা এবং দেশের প্রথম মেট্রো-শহর হিসেবে কলকাতা পুরসভা এলাকায় প্রকল্প চালু হয়েছিল।” এর পরেই তথ্য দিয়ে বিরোধী দলনেতা দাবি করেন, “বাম আমলে ২০১০ সালের জুন মাস পর্যন্ত যা হিসাব আছে, তাতে আমাদের রাজ্যের জন্য বরাদ্দ ৬৮৬ কোটি টাকার মধ্যে ৬৮৪ কোটির প্রকল্প আমরা জমা দিয়েছিলাম।
দেশের বড় রাজ্যগুলি যেখানে গড়ে ৪০ শতাংশ টাকা খরচ করেছিল, সেখানে আমরা সর্বোচ্চ ৫৭ শতাংশ টাকা খরচ করেছিলাম। আর এই সরকারের আমলে ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে।” সূর্যবাবুর মন্তব্য, “এর জন্য ঢক্কানিনাদের কোনও প্রয়োজন নেই!”
সিপিএমের অভিযোগ, ২০ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যার মাপকাঠিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলারও এই সংখ্যালঘু প্রকল্পের সুযোগ পাওয়া উচিত। কিন্তু ২০০১ সালের অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার জনগণনা বিবেচনা করায় সেই সুযোগ পূর্ব মেদিনীপুর পায়নি। এমনকী, এখনও পাচ্ছে না। বাম জমানায় সংখ্যালঘু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে তৃণমূল-পরিচালিত কলকাতা পুরসভা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের ‘অসহযোগিতা’য় কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দল কী ভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল, সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বিরোধী দলনেতা এ দিন আলিমুদ্দিনে বলেন, “১৫ মাসে এঁরা কিছু কাজ করেছেন ঠিকই। কিন্তু যেগুলো আমরা করেছিলাম, তার বেশির ভাগই নিজেরা করেছেন বলে চালাচ্ছেন!”
সংখ্যালঘুদের জন্য কলেজ, ছাত্রাবাস, পলিটেকনিক বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র একগুচ্ছ কাজ যে এই সরকারের আমলে আর এগোয়নি, তার খতিয়ান তুলে ধরেছেন সূর্যবাবু। রাজ্যে মোট ৯০০ এমএসকে (মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র)-এসএসকে (স্কুল শিক্ষা কেন্দ্র) হওয়ার কথা ছিল। যার মধ্যে প্রায় ৫০০ বাম আমলে হয়ে গিয়েছে। বাকি ৪০৫টির কাজে এই সরকার হাতই দেয়নি।
সূর্যবাবুর কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরা অনেক সময় সংখ্যালঘু নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলেন। কিন্তু তফসিলি জাতি-উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, সংখ্যালঘু বা মহিলাদের উন্নয়নে এই সরকারের ভূমিকা নেতিবাচক। যেখানে ছিল, সেখান থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। কত প্রকল্পের টাকা খরচ করতে পারছেন না, প্রায়শই সামনে আসছে।”
একই সঙ্গে বিরোধী দলনেতার ব্যাখ্যা, “উনি (মুখ্যমন্ত্রী) মুখ খুলেছেন বলেই আমাদের মুখ খুলতে হচ্ছে! সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের যা পাওয়া উচিত, একাদশ পরিকল্পনায় তা আছে। দ্বাদশ পরিকল্পনায় ফের নতুন প্রকল্প হবে।” |