ভিভিএস লক্ষ্মণ নিয়ে লিখতে বসে ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। ক্রিকেটারদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভদ্র, সবচেয়ে নম্র লক্ষ্মণ। বিশাল কোনও কম্পানির সিইও-র সঙ্গে যে ভাবে কথা বলবে, হোটেলের বেল-বয়ের সঙ্গেও সে ভাবেই কথা বলত। ওর মুখে কারও সম্পর্কে কোনও দিন খারাপ কিছু শুনিনি। দুর্দান্ত কয়েকটা ক্যাচ নিলেও লক্ষ্মণের ফিল্ডিংটা বেশ স্লো ছিল। সেটা নিয়ে ড্রেসিংরুমে কত মজা করা হত। ওর পেছনে লাগত বাকিরা। হাসাহাসি করত। আর লক্ষ্মণ সব সময় সেটা খুব স্পোর্টিং ভাবে নিত। ও-ই একমাত্র সিনিয়র যার পিছনে লাগা যেত। সব লিখতে গেলে শেষ করা যাবে না। তার চেয়ে সেরা পাঁচ স্মৃতির কথা বলি। মাঠের, মাঠের বাইরের।
‘ছাত্র’ লক্ষ্মণ: দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার অভিষেক সফর। পোর্ট এলিজাবেথে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সারা দিন ব্যাট করে ড্রেসিংরুমে ফিরেছি। এখনও মনে আছে, লক্ষ্মণ আমাকে জিজ্ঞেস করল, সারা দিন তোমার মাথায় কী চলছিল? কী ভাবে ফোকাস ঠিক রাখছিলে? অবাক হয়েছিলাম বললে খুব কম বলা হয়। আমি মোটে দুটো টেস্ট ম্যাচ খেলেছি, আর ও ভারতীয় ব্যাটিং আকাশের অত বড় নক্ষত্র। ও-ই কিনা আমার কাছ থেকে শিখতে চাইছে!
যখন দাদা-র ভূমিকায়: ২০০২-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরটা আমার কাছে খুব ভাল যাচ্ছিল না। বেশ চাপে ছিলাম। সেই সময় এক বার টিম ডিনারে লক্ষ্মণ আমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেছিল। আমাকে বুঝিয়েছিল, বেশি চিন্তা না করতে। ওর মতো সিনিয়রের এই ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছিলাম।
ইডেনে ইতিহাস: ২০০১-এর ইডেন টেস্টের কথা বাদ দিই কী করে? আমার দুর্ভাগ্য, ইডেনে বসে ওই স্বর্গীয় ইনিংস দেখতে পাইনি। রঞ্জি ট্রফির একটা ম্যাচ খেলে ফিরছিলাম। মুম্বই এয়ারপোর্টে পৌঁছে শুনলাম, ফ্লাইটের সময় বেশ অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে। তখন নিশ্চিত ছিলাম যে আমরা টেস্টটা হেরে যাব। তাই প্রথম দিকে ম্যাচটা দেখিওনি। হঠাৎ চা বিরতির পরে শুনলাম তখনও উইকেট পড়েনি। লক্ষ্মণের ইনিংসের পুরোটাই প্রায় দেখতে পেয়েছিলাম। ফ্লাইটের সময় পিছিয়ে যাওয়ার জন্য আজও ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই!
আচমকা ডান্স ফ্লোরে: ২০০৩-’০৪ অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে ফিরে বিয়ে করবে লক্ষ্মণ। ওই সফরে আমিও স্কোয়াডে ছিলাম। মনে আছে, দুটো টেস্টের মাঝখানে হোবার্টে দু’তিন দিনের বিশ্রাম ছিল। তখন হঠাৎই ঠিক হল, লক্ষ্মণকে ব্যাচেলার্স পার্টি দেওয়া হবে। জাহির, সচিন, নেহরা, ভাজ্জি, আমরা সবাই ডিনার করতে গিয়েছিলাম। লক্ষ্মণ এমনিতে খুব শান্ত, চুপচাপ। ব্যাচেলার্স পার্টিতে গিয়ে কী করল? পুরোটা বলা যাবে না। এটুকু বলি ওকে কিন্তু আমরা নাচিয়েওছিলাম! শ্রীসন্থের মতো ও নাচের আদবকায়দা জানে, একেবারেই বলব না। কিন্তু সে দিন ডান্স ফ্লোরে উঠতে আপত্তি করেনি। এতটাই স্পোর্টিং।
সুইচ অন, সুইচ অফ: ২০০২ অ্যাডিলেডে দুর্দান্ত পার্টনারশিপ হয়েছিল লক্ষ্মণ আর রাহুলের। আমরা মেলবোর্নে হেরে অ্যাডিলেডে নেমেছি। তড়াতাড়ি তিন-চারটে উইকেট চলে গিয়েছে। ওই অবস্থা থেকে ম্যাচটা আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দেয় ওরা। সে দিন লক্ষ্মণের আগ্রাসী মনোভাব দেখে অবাক হয়েছিলাম। সম্পূর্ণ অচেনা একটা লোক। কিন্তু ড্রেসিংরুমে ফেরার দু’মিনিটের মধ্যে আবার লোকটা পাল্টে গেল! মাঠের আগ্রাসনের ছিটেফোঁটাও নেই। জাহিরের পিছনে লাগছে। হরভজনকে জ্বালাচ্ছে। ও-ই একমাত্র ক্রিকেটার যাকে বলতে শুনেছি, মাঠের স্কোরটা পাঁচশোই হোক বা একশো অলআউট, ড্রেসিংরুমে যেন তার আঁচ না পড়ে। ড্রেসিংরুমটা সব সময় হাসিখুশি রাখতে হবে।
সে সব এখন স্মৃতিই হয়ে গেল। তবে সব শেষে একটা প্রশ্নও থাকছে। লক্ষ্মণকে নিয়ে নয়। ওর বদলি ক্রিকেটার বাছা নিয়ে। আইপিএলের পর থেকে বদ্রিনাথ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে নেই। তার জায়গায় কি মনোজ তিওয়ারিকে একটা সুযোগ দেওয়া যেত না? |