ওরা ‘বর্ষার দূত’। বর্ষার শুরুতেই ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করে ওরা। আবার শীত পড়লেই ফিরে যায় পুরনো আস্তানায়। দু’এক বছর নয়, প্রায় ২৫ বছর ধরে কালনার মানিকহার গ্রামে আনাগোনা ওদের।
ওরা শামুকখোল পাখির দল। বর্ষার সময়ে গ্রামে মাঠঘাট থেকে রাস্তাঘাট, সর্বত্রই দেখা মেলে তাদের। কালনা শহর থেকে কাঁকুরিয়া পঞ্চায়েতের ওই গ্রামটির দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত।
গ্রামবাসীরা জানান, গ্রামের পাশেই রয়েছে একটি বড় বিল। প্রায় আড়াই দশক আগে বিলের ধারেই গ্রামের বাসিন্দা দু’কড়ি শেখের ঝাঁকড়া বট গাছের ডালে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল এক দল শামুকখোল। সেই শুরু। তাঁদের দাবি, গ্রামে ওরা অতিথির সম্মান পায়। কেউ ওদের বিরক্ত করে করে না। ফলে ফি-বছর ওই পাখির সংখ্যা বাড়ছে।
গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, আমবাগান, বাশঁবাগান থেকে শুরু করে স্কুল, বাড়ির ছাদ সর্বত্রই তাদের অবাধ বিচরণ। লোকজন এমনকী পটকার আওয়াজেও ভয় পায় না তারা। গ্রামবাসীরা জানান, বর্ষার কয়েক দিন আগেই দল বেঁধে গ্রামে আসতে শুরু করে পাখির দল। সারাদিন খাবারের সন্ধানে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। বিকেল হলেই ফিরে আসে নিজের আস্তানায়। গ্রামবাসী ইসমাইল শেখ, জামিরউদ্দিন শেখরা বলেন, “ওরা বর্ষার দূত। গ্রামে ঢুকলেই বুঝে যাই এ বার বৃষ্টি নামবে। চাষাবাদ শুরু করতে হবে।” |
বাসিন্দারা জানান, সারা রাত ধরে চিল-চিৎকার জুড়লেও গ্রামের কেউ কিচ্ছুটি বলে না ওদের। ওই গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধা বাণিজা বিবির কথায়, “কোনও পাখি অসুস্থ হলে গ্রামের ছেলেরাই ওদের সেবা করে। ওরাও আর গ্রামে চরে বেড়াতে ভয় পায় না। ওরা যে ভালবাসার কথা বুঝতে পারে। যখন চলে যায়, মনে হয় কী যেন একটা নেই!”
শামুকখোলের পাখির আনাগোনার খবর পেয়েই গ্রামে আসতে শুরু করেছিল পাখি-শিকারির দল। প্রথম প্রথম তাদের কিছু বেশ কিছু পাখির প্রাণ গিয়েছিল। কিন্তু রুখে দাঁড়ান গ্রামবাসীরা। গ্রামের একটি ক্লাবের সদস্যেরা ঠিক করেন, শুধু পাখি মারা নয়, পাখিদের বিরক্ত করলেই জরিমানা দিতে হবে ৫০১ টাকা। ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয় চোরাশিকারিরা।
সম্প্রতি স্থানীয় মেদগাছি এলাকায় একটি স্বাস্থ্য শিবিরে গিয়েছিলেন পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক স্বপন দেবনাথ। সেখান থেকে জানতে পারেন মানিকহার গ্রামের এই পরিযায়ীদের কথা। পক্ষীপ্রেমীরা যাতে গ্রামে এসে এই পাখিদের দেখে যেতে পারেন তার জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের আবেদন জানান গ্রামবাসীরা। স্বপনবাবু যোগাযোগ করেন বন দফতরের জেলা আধিকারিকের সঙ্গে। গত ১৪ অগস্ট জেলা বনাধিকারিক গোপালচন্দ্র কাজুরি গ্রামে ঘুরে যান। তিনি বলেন, “গ্রামবাসীরা যে ভাবে পাখিদের আটকে রেখেছে তা প্রশংসনীয়। এমন গ্রামকে মডেল গ্রাম করে অন্যদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। গ্রামবাসীরা চাইলে এই গ্রামে আরও বনসৃজন করা যেতে পারে।” পাখি ও পর্যটকদের ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে তিনি জানান, দফতরের কাটোয়া রেঞ্জ অফিসারকে এই গ্রামে আশ্রয় নেওয়া শামুকখোলদের সংখ্যা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে একটি রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্টটি হাতে এলে বিষয়টি নিয়ে বিশদে ভাবা হবে।” কালনা ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শান্তি চাল জানান, বন দফতর মানিকহারের বিষয়ে ইতিবাচক আশ্বাস দিয়েছে। |