রোগী-মৃত্যুকে কেন্দ্র করিয়া আর জি কর হাসপাতালে শুক্রবার যাহা ঘটিয়াছে, ইদানীং তাহা রেওয়াজে পরিণত। রোগীর আত্মীয়-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা দলবদ্ধ হইয়া হাসপাতালে চড়াও হন, চিকিৎসক-নার্সদের যাঁহাদেরই হাতের কাছে পান, মারধর করেন এবং হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, আলো-পাখা, সাজসরঞ্জাম, এমনকী অপারেশন থিয়েটার পর্যন্ত ভাঙচুর করেন। কখনও প্রহৃত জুনিয়র ডাক্তাররা প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করিয়া চিকিৎসা পরিষেবাই বিপর্যস্ত করিয়া দিতেছেন। রোগীর আত্মীয়-বন্ধুদের এই তাণ্ডবে সর্বদা যে স্বজন-হারানোর বেদনার প্ররোচনা রহিয়াছে, এমন নয়। যে ভাবে ট্রাক কিংবা ম্যাটাডর বোঝাই করিয়া কয়েক শত লোক হাসপাতাল আক্রমণ করিয়াছে, তাহার মধ্যে মৃত্যুশোক অপেক্ষাও দুষ্কৃতকারীর আস্ফালন ও নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রেরণাই বেশি। বিরাটসংখ্যক পুলিশ বাহিনী অকুস্থলে আনাইয়াও সহজে এই দুষ্কৃতীদের শায়েস্তা করা যায় নাই।
কেন এমন অবস্থা? এই ধরনের হাঙ্গামা মোকাবিলায় কড়া আইন রহিয়াছে, জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার এবং তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডের বিধিও আছে। তবে উপর্যুপরি তাণ্ডবের পরেও দুষ্কৃতীরা সাজা পায় না, এমনকী গ্রেফতারও হয় না কেন? কেনই বা অচিরে জামিন পাইয়া যায়? হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থাই বা এত শিথিল কেন? প্রতিটি হাঙ্গামার পর মোতায়েন পুলিশের সংখ্যা কিছু বাড়িলেও অচিরেই তাহাদের অন্যত্র ‘ডিউটি’তে সরাইয়া দেওয়া হয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি এবং হামলাকারীদের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাবই কিন্তু এ ধরনের তাণ্ডবে লিপ্ত হইতে দুর্বৃত্তদের উৎসাহিত করিতেছে। সমাজবিরোধীরা যদি জানে, তাহারা যথেচ্ছ মারধর, ভাঙচুর, লুঠপাট চালাইতে পারিবে, পুলিশ কিছু বলিবে না, ধরপাকড় করিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতে তুলিবে না, তুলিলেও দণ্ডবিধির এমন সব হালকা ধারায় অভিযোগ আনিবে যে জামিন পাইতে অসুবিধা হইবে না, তাহা হইলে তাহাদের পেশিশক্তির প্রদর্শনী চমকপ্রদ হইতে বাধ্য। হাসপাতাল যে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জায়গা নয়, এখানে ভাঙচুর করিলে অন্য রোগীদের চিকিৎসাই যে ব্যাহত হয়, এই সব সুভাষিতাবলি দুষ্কৃতীদের শুনাইয়া লাভ নাই।
শাসক বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান সমালোচনা ছিল, তাহারা প্রশাসনকে দুর্বল করিয়াছে। সমালোচনাটি অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু পালাবদলের পরে পরে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের দায়িত্ব ছিল প্রশাসনকে সবল করিয়া তোলা। পনেরো মাসে প্রশাসন সবল হইবার লক্ষণ নাই, বরং অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত লক্ষণই স্পষ্ট। যাহা খুশি করিয়া পার পাওয়া যাইবে এই ধারণাটি উত্তরোত্তর প্রসারিত হইতেছে। হাসপাতালে উপদ্রব নূতন নহে, কিন্তু যে ভাবে আর জি করের আক্রমণটি সংগঠিত হইয়াছে, তাহা এ রাজ্যের ইতিহাসেও খুব সুলভ নয়। নৈরাজ্যকে কঠোর ভাবে দমন না করিলে তাহা মাথায় চড়িয়া বসিবেই। শুক্রবারের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে কিছু লোককে গ্রেফতার করা হইয়াছে। প্রয়োজন দ্রুত এবং যথাযথ বিচার। |