বোধোদয় হওয়া ভাল। সময়ে হইলে আরও ভাল, যদিও বিলম্বে হওয়াই দস্তুর। যেমন, গৌতম দেবের হইয়াছে। তিনি সি পি আই এম-এর ছাত্র সংগঠনের সভায় তাঁহার নূতন বোধের কথা খোলসা করিয়া বলিলেন। তিনি সংগঠনের কর্মীদের তিরস্কারের সুরে বলিলেন, যখন রাজ্যে তাঁহাদের দল ক্ষমতায় ছিল, তখন বিভিন্ন কলেজে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করা তাঁহাদের উচিত হয় নাই। গায়ের জোরে বিরোধীদের সূচ্যগ্রপরিমাণ জমিও না ছাড়া যে ঠিক হয় নাই, গৌতম দেব সেই কথাটি এত দিনে বুঝিয়াছেন। তাঁহারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন সম্ভবত তিনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে এই সংবাদগুলি তাঁহার নিকট পৌঁছায় নাই। এখন অবসর পাইয়া ভাবিয়া দেখিতেছেন। তবে, তাঁহারা ক্ষমতায় ফিরিলে নেতৃবর আবার ব্যস্ত হইয়া পড়িবেন এবং এই জাতীয় তুচ্ছ বিষয় ফের বিস্মৃত হইবেন, সেই আশঙ্কা বিলক্ষণ আছে। এখন তাঁহার দল মসনদের গৌরবহীন, একা। একদা যে অস্ত্রে তাঁহার দল রাজ্যের সব কলেজে নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করিত, সেই অস্ত্রের অভিমুখ এখন তাঁহাদেরই দিকে। সেই অস্ত্র প্রয়োগের অন্যায্যতা, অতএব, তাঁহারা বুঝিতেছেন। কিন্তু, যে বিষবৃক্ষ তাঁহারা রোপণ করিয়াছেন, তাহার ফল ভোগ করা ভিন্ন উপায় কী?
নিরঙ্কুশ আধিপত্য নির্মাণের সংস্কৃতিটি রাজ্য রাজনীতিতে সি পি আই এম-এর নিজস্ব দান। লোকাল কমিটিই যে ঈশ্বর এই কথাটি দল সর্বশক্তিতে প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। আদর্শগত বামপন্থাকে বহুলাংশে বিসর্জন দিলেও বামপন্থী সর্বগ্রাসের প্রবণতাটি দলের বিলক্ষণ ছিল। রাজ্যের নাড়ি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বাঁধিতে সব কলেজে দলের ছাত্র সংগঠনকে জিতাইয়া আনা হইয়াছে, প্রায় সব শিক্ষককে দলের শিক্ষক সংগঠনের সদস্য হইতে হইয়াছে। সব বাস-অটো-ট্যাক্সি-রিকশা স্ট্যান্ডে দলের পতাকা উড়িয়াছে, সব বাজারে দলের চাঁদা উঠিয়াছে, সব কারখানার বন্ধ দরজায় লাল পতাকা বাঁধা হইয়াছে। বামপন্থীরা ভাবিয়াছিলেন, এই প্রতিষ্ঠা বুঝি অক্ষয়। তাঁহারা বোঝেন নাই, তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটি প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহাদের সৃষ্ট ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। বস্তুত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সি পি আই এম-এর পাঠশালার সেরা পড়ুয়া ছিলেন। অগণতান্ত্রিকতার যতগুলি অস্ত্র সি পি আই এম-এর তূণে ছিল, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় তাহার প্রত্যেকটি চালাইতে পারদর্শী। রাজ্যব্যাপী নিরঙ্কুশ আধিপত্যের মায়া-অঞ্জন তাঁহার চোখেও বিলক্ষণ আছে, এবং সেই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তাঁহার পূর্বসূরিদের দেখানো পথেই হাঁটিতে স্বচ্ছন্দ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভাষা ধার করিলে, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায় বামপন্থীদের মুদ্রাতেই তাঁহাদের হিসাব মিটাইতেছেন। গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হইতেছে, কিন্তু তাহাতে কাহার কী?
গণতন্ত্র একটি পরিসর ক্ষমতাসীনদের সহিত বিরোধীদের আলোচনার, মত বিনিময়ের, দর-কষাকষির পরিসর। সেই পরিসরে শাসকের গুরুত্ব যতখানি, বিরোধীর গুরুত্ব বস্তুত তাহার তুলনায় বেশি। কারণ, ক্ষমতার দ্যুতি অনেক ক্ষেত্রেই শাসককে অন্ধ করিয়া দেয়। বিরোধীর কাজ, শাসককে তাহার দোষত্রুটি দেখাইয়া দেওয়া। আমি তোমার সহিত কণামাত্র সহমত নই, কিন্তু তুমি যাহাতে নিজের মত বিনা বাধায় প্রকাশ করিতে পারো, তাহা নিশ্চিত করিবার জন্য আমি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পারি গণতন্ত্রে ইহাই শাসকের অবস্থান হওয়া বিধেয়। পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, সি পি আই এম-রোপিত বিষবৃক্ষের ফল এই রাজ্যকে ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। বিরোধীকে জায়গা করিয়া দেওয়ার প্রশ্নই নাই, বিরোধী কণ্ঠস্বরমাত্রেই তাহাকে দমন করাই এখন এই রাজ্যে রাজনীতির পরাকাষ্ঠা। গণতন্ত্রের এই অবমাননা রোধ করিবার ক্ষমতা এক জনেরই ছিল। কিন্তু তিনি কাহারও প্রশ্ন মনোমত না হইলেই প্রশ্নকর্তাকে ‘মাওবাদী’ বলিয়া দাগাইয়া দিতেছেন। অতএব, পশ্চিমবঙ্গ বদলাইবে না। কাল গৌতম দেবরা ক্ষমতায় আসিলে ফের তাঁহারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার খেলা খেলিবেন। আজকের শাসকরা কাল বিরোধী হইলে তখন তাঁহাদের বোধোদয় হইবে। রাজ্যবাসী দর্শকের ভূমিকায়। অদৃষ্টকে দোষ দেওয়া ভিন্ন তাহাদের আর কিছু করিবার নাই। |