আষাঢ়-শ্রাবণ ডাহা ফেল। পাশ নম্বরের জন্য তাকিয়ে থাকতে হবে ভাদ্র-আশ্বিনের দিকে!
বর্ষাকালে তেমন বৃষ্টিই হল না। ভরসা এখন শরৎকাল। ভাদ্র-আশ্বিনের বৃষ্টি কার্তিকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাড়া করবে বলে মনে করছেন আবহবিদদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, যে ভাবে বর্ষার নির্ঘণ্ট বদলে যাচ্ছে, তাতে ঋতুচক্রের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বিশেষ করে গত প্রায় এক দশক ধরে বর্ষা পিছোতে পিছোতে যে ভাবে হেমন্তের ঘাড়ের উপরে পড়েছে, তাতে তার যায় যায় অবস্থা!
শুধু হেমন্তই নয়। ঋতুচক্রের প্রভাব পড়েছে বসন্তের উপরেও। এ বার তো কলকাতাতে শীতটা পিছিয়ে ফাল্গুনের মাঝামাঝি চলে এসেছিল। আবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চড়চড় করে বাড়তে শুরু করেছিল চৈত্রের শুরুতেই। গ্রীষ্মকালটা সাত তাড়াতাড়ি চলে আসায় অনেকে ভেবেছিলেন, এ বার জুনে স্বাভাবিক বর্ষণ হবে। দিল্লির মৌসম ভবনও তাদের দু’দফার পূর্বাভাসে একই ভুল করে বসেছিল। এ বার বর্ষার মতিগতি দেখে মৌসম ভবনের এক আবহবিদের মন্তব্য, “পূর্ব ভারতে বর্ষা দেশের অন্য অংশের থেকে বেশি দিন থাকে। এ বার যে হেতু বর্ষা পথেই অনেক দেরি করে ফেলেছে, তাই শেষ পর্যন্ত তা পিছিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে আমরাও চিন্তিত।”
আর বর্ষা দেরি করে ফেললে এ বারও যে হেমন্তের ঘাড়েই কোপ পড়বে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই আবহবিদদের। তবে বর্ষার নির্ঘণ্ট পাকাপাকি ভাবে বদলে গেল কি না, তা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন কেউই।
দেশের দক্ষিণ ও পূর্ব অংশে বর্ষা অনেক আগে আসে। সেখানে বৃষ্টিও হয় তুলনায় বেশি। এ বার দক্ষিণে বর্ষা ঠিক সময়ে এলেও, পূর্ব ভারতে বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডে তা এসেছে অনেক দেরিতে। ছত্তীসগঢ়-মধ্যপ্রদেশে প্রবল বর্ষণের জেরে এখন বিহার ও ঝাড়খণ্ডে প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। বর্ধমানের শিল্পাঞ্চল, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলাতেও ভাল বৃষ্টি হচ্ছে। তাতে সামগ্রিক ভাবে দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার ঘাটতি কমলেও বৃষ্টির সামঞ্জস্য না থাকায় ভুগছে কলকাতা সংলগ্ন জেলাগুলি। |
অগস্টের গোড়া থেকেই বিহার ও সংলগ্ন এলাকার উপরে রয়েছে একটি ঘূর্ণাবর্ত। ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে মধ্য ভারত এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের উপরেও। তার ফলে বর্ষা এখন জোরদার ভারতের অনেক রাজ্যেই। রাজস্থান, গুজরাতে খরার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ভাল বৃষ্টি সেই আশঙ্কা অনেকটাই কাটিয়ে দিয়েছে। খরার আশঙ্কা কেটেছে কর্নাটকেও। পঞ্জাব, হরিয়ানা ছাড়া উত্তর ভারতের অন্য রাজ্যগুলিতেও ঘাটতি অনেকটা কমে এসেছে। ব্যতিক্রম দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলা। কলকাতায় ঘাটতি ৩৬ শতাংশ রয়ে গিয়েছে। আশপাশের জেলাগুলিতে কোথাও ঘাটতি ৩৯ শতাংশ, কোথাও বা ৩৬ শতাংশ।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের এক আবহবিদ জানাচ্ছেন, “উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সেপ্টেম্বরের পরে আর জোরদার বৃষ্টির সম্ভবনা নেই। কিন্তু গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি হচ্ছে নভেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। ২০০৯ সালে দক্ষিণবঙ্গের ১০টি জেলায় খরা ঘোষণা করতে হয়েছিল। সে বার বর্ষার সময়ে বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু নভেম্বরে জোরদার বৃষ্টি নেমেছিল। এ বারও সে রকম হওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।”
তবে রাজ্যের কৃষি দফতর এই মুহূর্তে আর অতিরিক্ত বৃষ্টি চায় না। কৃষি দফতরের এক বিশেষজ্ঞের কথায়, “উত্তর ভারত, মধ্য ভারত এবং বিহার-ঝাড়খণ্ডে বর্ষা এখন ঘাটতি মেটাতে এতটাই সক্রিয় যে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া, হাওড়ায় কৃষকেরা বৃষ্টির ঘাটতি অনেকটাই পুষিয়ে নিয়েছেন পাম্প চালিয়ে। এখন ভারী বর্ষণ হলে ক্ষতিই হবে বেশি।” তবে কৃষি বিশেষজ্ঞেরা চিন্তিত ঋতুচক্র বদলের ধরনে। এক কৃষি বিশেষজ্ঞ বলেন, “পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চাষের পদ্ধতি বদলানোর কথা ভাবতে হবে আমাদের। আর আবহাওয়ার ধরন-ধারণ এ ভাবে বদলে যেতে থাকলে কীট-পতঙ্গের জিনগত পরিবর্তনও হবে দ্রুত। যা মোকাবিলার পথ এখনও আমাদের অজানা।”
তবে এ বারের এই ঘাটতি বৃষ্টি কলকাতাবাসীর দুর্ভোগ কিছুটা কমিয়েছে। এ বারের বর্ষায় এক দিনের জন্যও জলবন্দি হতে হয়নি কলকাতাকে। কলকাতা পুরসভার আধিকারিকেরা বলছেন, কলকাতায় খুব কম সময়ের মধ্যে ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে জলবন্দি হয়ে পড়ে শহরের অনেক এলাকা। এ বার জুলাই মাসে এক দিন তিন ঘণ্টায় ৮৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। অনেকটা সময় জুড়ে বৃষ্টি হওয়ায় জল নেমে গিয়েছে দ্রুত।
পুরসভার নিকাশি বিভাগের দাবি, ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও শহরের জল যাতে তাড়াতাড়ি নেমে যায় সেই পরিকাঠামো এই মুহূর্তে তাদের রয়েছে। আবহবিদেরা মনে করছেন, ভাদ্র-আশ্বিন মাসেই সেই পরীক্ষায় বসতে হতে পারে কলকাতা পুরসভাকে। কারণ তাঁরা মনে করছেন, পুজোর মুখে ভারী বর্ষণের আশঙ্কা থাকছে। |