পাহাড়, জঙ্গলমহলে পরিস্থিতি পরিবর্তনের বিষয়টি আগেই স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বার সংখ্যালঘু উন্নয়নেও রাজ্য সরকারের ‘সাফল্য’ মেনে নিল কেন্দ্রীয় সরকার। শুধু মেনে নেওয়াই নয়, সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্য রাজ্যের বরাদ্দ কেটে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা ‘ইনাম’ দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। কুড়ি শতাংশের বেশি সংখ্যালঘুর বাস, রাজ্যের এমন ১২টি জেলা সরেজমিনে দেখে তবেই নতুন সরকারকে ওই শংসাপত্র দিয়েছেন দিল্লির কর্তারা। তার পরেই সংখ্যালঘু উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে রাজ্যকে উৎসাহ দিতে দরাজ হয়েছেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী সলমন খুরশিদ। রাজ্যের দাবি শোনা মাত্রই অতিরিক্ত বরাদ্দ মঞ্জুর করেছেন তিনি। অতিরিক্ত টাকায় নতুন মেডিক্যাল কলেজ থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জল প্রকল্প, নতুন আইটিআই তৈরি থেকে গৃহ নির্মাণের একগুচ্ছ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
সংখ্যালঘু উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর ১৫ দফা কর্মসূচি রূপায়ণে বহুবিধ উন্নয়ন প্রকল্প (এমএসডিপি) হাতে নিয়েছে কেন্দ্র। একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৬৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। তার মধ্যে কেন্দ্র এখনও পর্যন্ত ৬২৫ কোটি টাকা রাজ্যকে পাঠিয়েছে। তথ্য বলছে, এর ৮০%ই খরচ করে ফেলেছে রাজ্য। সব চেয়ে ভাল কাজ হয়েছে বধর্মান, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলায়। এই তিন জেলায় বরাদ্দের ৯০% টাকাই খরচ হয়ে গিয়েছে। |
এমএসডিপি-র প্রকল্পগুলি পর্যালোচনা করতে গত জুলাই মাসে দিল্লিতে বৈঠক ডেকেছিল যোজনা কমিশন। রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের যুগ্মসচিব পারভেজ বি সেলিম সেখানে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতির কথা তুলে ধরে অতিরিক্ত ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানান। বৈঠকে উপস্থিত খুরশিদ আলম রাজ্যের কাজে সন্তোষ প্রকাশ করে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই রাজ্যে সংখ্যালঘুদের একটি বড় অংশ বামেদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়েছে। এর পর প্রতিটি নির্বাচনেই তারা তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিয়েছে। ‘প্রতিদানে’ মুখ্যমন্ত্রীও রাজ্যের প্রায় ৩০% এই জনগোষ্ঠীর জন্য একের পর এক প্রকল্প নিয়েছেন। বিশেষ নজর দিতে নিজের হাতে রেখেছেন সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর। এমনকী চলতি আর্থিক বছরে (২০১২-১৩) দফতরের বাজেট বরাদ্দও ৩৩০ কোটি থেকে প্রায় ৭০% বাড়িয়ে ৫৭০ কোটি করেছেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সংখ্যালঘু উন্নয়নকে পাখির চোখ করে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটেও এগোতে চান মুখ্যমন্ত্রী। এই পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি টাকা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই মনে করছেন সংখ্যালঘু দফতরের কর্তারা।
দফতরের সচিব বিক্রম সেনের কথায়, “আমাদের কাজের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী ওয়াকিবহাল। তাঁর প্রতিনিয়ত খোঁজখবরের ঠেলায় দফতরের অফিসার থেকে কর্মী সকলেই সজাগ। বরাদ্দ অর্থ খরচের সাফল্যের অন্যতম কারণ এটা। তারই স্বীকৃতি হিসেবে কেন্দ্র বাড়তি বরাদ্দ দিয়েছে।” মহাকরণের কর্তাদের দাবি, শুধু সংখ্যালঘু উন্নয়ন নয়, যে দফতরগুলিকে অগ্রাধিকার দেন মুখ্যমন্ত্রী তাদের কাজও তুলনামূলক ভাবে ভাল হচ্ছে।
আবার এর পাশাপাশি অন্য ছবিও আছে। যেমন, প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর কেন্দ্রীয় অর্থের ৪২ কোটি টাকা খরচ করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট দফতরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শরদ পওয়ার চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, সময়ে টাকা খরচ না হলে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হবে। একই ভাবে কৃষি দফতরের বিভিন্ন প্রকল্পে প্রায় ১০৬১ কোটি টাকা সময়মতো খরচ না হওয়ায় রাজ্যকে সতর্ক করেছে কেন্দ্র। সরকারের প্রথম দিকে ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনা, গ্রামীণ জল সরবরাহ প্রকল্প নিয়েও মুখ্যমন্ত্রীকে কয়েকটি চিঠি লিখে কাজে গতি আনার কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। বরাদ্দ টাকার খরচ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকা স্বাস্থ্য দফতরও। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, ব্যাকওয়ার্ড রিজিওন গ্রান্ট ফান্ড বা বিআরজিএফ (স্পেশ্যাল)-সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অগ্রগতিও আশানুরূপ নয় বলে অভিমত দিল্লির। এরই মধ্যে সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের কাজে কেন্দ্রের স্বীকৃতি কিছুটা ব্যতিক্রমী বলেই মনে করছে রাজ্য প্রশাসন।
গত প্রায় দেড় বছরে কেন্দ্রের কাছে নানা আর্থিক দাবি করছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এ পর্যন্ত বিআরজিএফ (স্পেশাল) প্রকল্পে ৮৫০০ কোটি টাকা ছাড়া প্রায় কোনও অর্থই জোটেনি রাজ্যের। সেই হিসাবে সংখ্যালঘু উন্নয়নে বাড়তি ৩০০ কোটি টাকার বরাদ্দ কেন্দ্রের ইউপিএ-এর মেজ শরিককে খুশি করার চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। |