পালতোলা নৌকোয় চেপে একা পৃথিবী পরিক্রমা! তা-ও কোথাও না থেমে!
মনে হতে পারে, লোকে যখন হামেশাই মহাকাশে যাচ্ছে আর এভারেস্টের চুড়োয় উঠছে, তখন এ আর এমন কী? কিন্তু যখন দেখা যায়, এ যাবৎ মহাকাশ বা এভারেস্ট ছোঁয়া লোকেদের চেয়ে পালতোলা নৌকোয় পৃথিবী পরিক্রমা করা মানুষের সংখ্যাটা অনেক কম, তখন ভাবতে হয় বৈকি। আর যখন সেই কাজটাই এ বার এক ভারতীয় করতে চলেছেন। অবশ্য দু’বছর আগেই নৌবাহিনীর কম্যান্ডার দিলীপ দোণ্ডে পালতোলা নৌকোয় পৃথিবী পরিক্রমা করে ফিরেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনিই প্রথম ভারতীয়। কিন্তু দোণ্ডে বিভিন্ন দেশের বন্দরে থেমেছিলেন। এ বার কোথাও না থেমে, মুম্বই থেকে নৌকোয় উঠে ফের সেখানেই এসে নামার পরিকল্পনা নিয়ে যাত্রা শুরু করছেন দিলীপের ‘শিষ্য’ অভিলাষ টোমি। পেশায় নৌবাহিনীর পাইলট, লেফটেন্যান্ট কম্যান্ডার টোমি আসলে ‘শখের নাবিক’।
কাকে বলে সমুদ্রপথে পৃথিবী পরিক্রমা? আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বলছে, যে বন্দরে যাত্রা শুরু, সেখানেই শেষ করতে হবে। সবক’টি দ্রাঘিমারেখা অন্তত এক বার পেরোতে করতে হবে। বিষুবরেখা অতিক্রম করতে হবে দু’বার। মোট অতিক্রান্ত দূরত্ব হতে হবে অন্তত ৩৮ হাজার ৮৮০ কিলোমিটার (কারণ, এটা বিষুবরেখার দৈর্ঘ্য আপনি মেরু অঞ্চল ঘেঁষে নৌকো চালিয়ে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্ব ঘুরে পৃথিবী পরিক্রমার দাবি তুলবেন, সেটা হবে না)। কোনও প্রণালী বা খাল ব্যবহার করা চলবে না। কারণ, প্রথমত সেটা ‘শর্টকাট’। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ খাল বা প্রণালী পেরোতে ইঞ্জিনচালিত নৌকো লাগবেই। কিন্তু এ ধরনের অভিযানে সেটা নিয়মবিরুদ্ধ। আরও একটা নিয়ম হল, অভিযাত্রীকে অস্ট্রেলিয়ার ‘লিউইন’, দক্ষিণ আমেরিকার ‘হর্ন’ এবং আফ্রিকার ‘উত্তমাশা’ (গুড হোপ) এই তিন অন্তরীপে পাক খেয়ে আসতে হবে। দীর্ঘ শর্ত, দীর্ঘ পথ, দীর্ঘ যাত্রা। অভিলাষের কথায়, “আমার হিসেবে সময় লাগবে অন্তত ৬ মাস। নভেম্বরে যাত্রা শুরু করে আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে ফেরার পরিকল্পনা রয়েছে।” ‘মাদেই’ নামের যে নৌকোয় চেপে বিয়াল্লিশ বছরের দিলীপ দোণ্ডে পৃথিবী ঘুরে এসেছিলেন, সেই একই নৌকো নিয়ে ভাসবেন বছর তেত্রিশের অভিলাষ। চ্যালেঞ্জটা কোথায়? দোণ্ডে বলেন, “আমি তো বিভিন্ন বন্দরে থেমেছিলাম। নৌকো মেরামতি, লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ, এ সবের সুযোগ ছিল। অভিলাষের চ্যালেঞ্জটা সেখানেই। নৌকো চালানো থেকে মেরামত, সব ওকেই সামলাতে হবে। আর খাওয়াদাওয়া? অভিলাষ জানাচ্ছেন, ৫৬ ফুট লম্বা নৌকোয় একশো কেজি খাবারদাবার নিয়ে জলে ভাসবেন তিনি। পানীয় জলের ট্যাঙ্কে ৬০০ লিটার জল নেওয়া যায়। আরও ২০০ লিটার বোতলের জল নেবেন। তবে দিনে ৫০০ গ্রাম খাবার ও এক লিটার জলের উপর ভরসা করে টিকে থাকার জন্য এখন থেকেই শারীরিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ‘কাছেপিঠে’ কয়েক হাজার মাইল পাড়ির কয়েকটা মহড়াও দিয়েছেন।
দোণ্ডে অবশ্য জানাচ্ছেন, শুধু শারীরিক প্রস্তুতিটাই আসল নয়। মনের জোরটাও হওয়া দরকার ইস্পাতের মতো। বললেন, “আমি অনেক বন্দরে থেমেছিলাম ঠিকই। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে দু’তিন হাজার মাইলের মধ্যে কোনও ভূখণ্ড নেই। প্রতি দু’সেকেন্ডে তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু ঢেউ আসছে। তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রির মধ্যে। চার-পাঁচদিন ধরে টানা এমন চলার পরে মনে হয়, কেন মরতে এলাম। আর সত্যিই আপনি ঢেউয়ের ধাক্কায় জলে পড়ে গেলে বড়জোর কাছের বন্দরে খবর পাঠাতে পারেন, বিপদে পড়েছেন। ওইটুকুই। কারও পক্ষে বাঁচানো সম্ভব নয়।” মৃত্যুভয়? দোণ্ডে বলেন, “এক পাগল ছাড়া এই অভিযানে ভয় পাবে না, এমন লোক পাওয়া মুশকিল। অনেক বারই খারাপ আবহাওয়ায় পড়ে মনে হয়েছিল, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে শেষ বার কথা বলে নিই। আর হয়তো সুযোগ মিলবে না। অন্য ভয়ও আছে। পালতোলা নৌকোয় কোনও ইঞ্জিন থাকে না, তাই শব্দও হয় না। ফলে সমুদ্রের প্রাণীরা নির্ভয়ে নৌকোর কাছে চলে আসে। এক বার টানা আধ ঘণ্টা একটা তিমি পরিবার নৌকোর আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছিল। কিন্তু পালানোর তো কোনও পথ নেই।” |
বিস্তীর্ণ সমুদ্রে তা হলে একা একা সময় কাটাতেন কী করে? দোণ্ডে বলেন, “আসলে প্রচণ্ড ব্যস্ততা থাকে। হাওয়ার গতি ও ঢেউ অনুযায়ী নৌকোর দিকনির্দেশ করা, নৌকোর রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়মিত খবর পাঠানো, সমস্ত তথ্য রাখা, ছবি তোলা, রান্নাবান্না, খাওয়া, বাসন মাজা, কাপড় কাচা সারা দিন এই করেই কেটে যায়। সমুদ্র শান্ত থাকলে, আবহাওয়া ভাল থাকলে নৌকোয় বসে ল্যাপটপে সিনেমা দেখা, গান শোনা বা বই পড়ার সুযোগও মেলে।” দোণ্ডে যাত্রা শুরু করেছিলেন ২০০৯ সালের অগস্টে। ফিরেছিলেন পরের বছর মে মাসে।
অভিলাষ যেহেতু কোথাও থামবেন না, তাই তাঁর কম সময় লাগারই কথা। সে কথা উঠলে আবার দু’জনেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পালতোলা নৌকোয় চাইলেই সরলরেখায় যাওয়া যাবে না। যে দিকে যখন হাওয়া বইবে, ঢেউয়ের ধাক্কা যে দিকে বেশি লাগবে, সে দিকেই এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে।
অবশ্য দুঃসাহসী গুরু-শিষ্যের কাছে এ বাধা আর এমন কী! তাঁরা তো বলেই দিচ্ছেন, সাহস আর পরিশ্রমে ভর করে এক অভূতপূর্ব নজির গড়াটাই তাঁদের পাখির চোখ। মনে পড়ে, চার দশক আগে এমন সাহসে ভর করেই ডিঙিনৌকো ‘কনৌজি আংরে’-তে চেপে দুই তরুণ পিনাকীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এবং জর্জ অ্যালবার্ট ডিউক পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে আন্দামান। এই শতকে দিলীপ দোণ্ডে, অভিলাষ টোমিরা আছেন। জ্বালিয়ে রেখেছেন সাগরপাড়ির স্ফূলিঙ্গ! |