সচিন বোঝালেও মত পাল্টালেন না লক্ষ্মণ
বেঙ্গিপুরাপ্পু বেঙ্কট সাই লক্ষ্মণ। ১৮ অগস্ট, ২০১২ থেকে ভারতের প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটার —ঘোষিত হওয়ার ততক্ষণে এক ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। প্রায়ান্ধকার, ফাঁকা উপ্পল স্টেডিয়ামের পিচের কাছাকাছি দুটো ছায়ামূর্তি দেখা গেল উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত ছুড়ে ছুড়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে! কে ওঁরা? এই পিচেই তো আর পাঁচ দিন পরেই ভারত-নিউজিল্যান্ড টেস্ট সিরিজ শুরু হতে চলেছে। সম্পূর্ণ উল্টো দিকের ‘নর্থ স্ট্যান্ড’ থেকে অত অল্প আলোয় ছায়ামূর্তিদ্বয়কে শনাক্ত করা কঠিন। এক ঘণ্টা আগেই হায়দরাবাদ ক্রিকেট সংস্থার কার্যকরী কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে যে ‘নর্থ স্ট্যান্ড’-এর নামকরণ হয়েছে ‘ভিভিএস লক্ষ্মণ স্ট্যান্ড’। যার উল্টো দিকের গ্যালারির নাম ‘শিবলাল যাদব প্যাভিলিয়ন স্ট্যান্ড’।
আর কী আশ্চর্য! গ্যালারি থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের এড়িয়ে মাঠে ঢুকে পড়ে একটু এগোতেই আবিষ্কার করা গেল, ছায়ামূর্তি দুটো হলেন লক্ষ্মণ আর শিবলাল!
টাটকা-টাটকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া লক্ষ্মণ তখন নিজের শহরের প্রাক্তন টেস্ট ক্রিকেটারকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন কেন, কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে তাঁকে এহেন আকস্মিক কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিতে হল। অত্যাশ্চর্য সিদ্ধান্ত বললেও অত্যুক্তি হবে না বোধহয়! কারণ ভারতীয় ক্রিকেটে এ রকম নজির নেই। বিশ্ব ক্রিকেটেও আছে কি না এই মুহূর্তে চট করে মনে পড়ছে না। নজিরবিহীন ভাবে ভিভিএস লক্ষ্মণ নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোটা সিরিজের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পরেও সিরিজ শুরু হওয়ার আগেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল সিদ্ধান্ত!
অবসরের পর: স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ের সঙ্গে লক্ষ্মণ। হায়দরাবাদে। ছবি: পিটিআই
লক্ষ্মণেরই কথায়, গতকাল রাত পর্যন্তও তিনি নিশ্চিত হতে পারছিলেন না, আজ বিকেলে হায়দরাবাদে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে ‘টাটা-বাই বাই’ করে দেবেন কি না। শনিবার সকালে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। সরকারি ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। ডাক্তার বাবা-মা’কে সকালে জানিয়েছিলেন। যে বাবা-মা লক্ষ্মণকে তাঁর আট বছর বয়সে বলেছিলেন, “তুমিই সিদ্ধান্ত নাও যে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, নাকি ক্রিকেটার হবে। কারণ ডাক্তারি তোমার রক্তে আছে। আর ক্রিকেটে তোমার প্রতিভা আছে। তোমার ‘ইনার ভয়েস’, মনের ভেতর থেকে যেটা চায় সেটাই কোরো তুমি।” এ দিনও অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলনে সেই পুরনো কাহিনি শোনালেন ১৩৪ টেস্টে ৮৭৮১ রান (সর্বোচ্চ ২৮১) করা (গড় ৪৫.৯৭) লক্ষ্মণ। ভিড়ে ঠাসা হলঘরের প্রথম সারিতে তখন বসে আছেন লক্ষ্মণের বাবা ডাক্তার শান্তারাম এবং মা ডাক্তার সত্যবামা। তাঁদের সঙ্গেই বসা লক্ষ্মণের স্ত্রী শৈলজা, ছেলে সর্বজিৎ, মেয়ে আশিন্তা। সস্ত্রীক ভাই জয়রামকৃষ্ণ। লক্ষ্মণের কাকা-কাম-মেন্টর কৃষ্ণমোহন। গোটা পরিবার।
কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণার আগে পর্যন্ত স্ত্রীকে লক্ষ্মণ জানাননি, তিনি এ দিন থেকেই ক্রিকেট-বানপ্রস্থে চলে যাচ্ছেন। নিউজিল্যান্ড সিরিজ না খেলেই। “আমি এই মুহূর্ত থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলাম।” লক্ষ্মণ তাঁর ছাপানো বিবৃতি পড়ার সময় শৈলজা আবেগে কেঁদে ফেললেন প্রকাশ্যে। পরে লক্ষ্মণ বলছিলেন, “ও এমনিতেই ভীষণ আবেগপ্রবণ। ওকে আজ সকালে বললেও আমাকে চাপ দিত অন্তত হায়দরাবাদ টেস্টটা পরের সপ্তাহে খেলে দাও। স্ত্রীকে ‘না’ বলতে পারতাম না। সে জন্য একেবারে সাংবাদিক সম্মেলনে কথাটা শুনে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। শৈলজার জন্য কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ ছাড়া আমার কিছু করার ছিল না।” কালো স্যুট পরা লক্ষ্মণকে আরও এক বার ভেঙে পড়া দেখাল যখন মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আনন্দবাজারকে বললেন, “সবচেয়ে কষ্ট হয়েছে সচিন, সহবাগ...আমার এত বছরের টিমমেটদের আজ সকালে নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা ফোনে জানাতে গিয়ে। সচিনের সঙ্গে পাক্কা চল্লিশ মিনিট কথা হয়েছে আজ। ও-ও নিউজিল্যান্ড সিরিজটা খেলার জন্য বোঝাচ্ছিল। আমি ওকে বললাম, তার পরে তো শ্রীকান্ত (নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান) আমার মাথা ভাঙবে। তার চেয়ে আগেই সম্মান নিয়ে চলে যাওয়া ভাল।”
এবং এটাই ১৮ অগস্ট ২০১২-র বিকেলে ভিভিএস লক্ষ্মণের মহানাটকীয় অবসরের পর্দার আড়ালের দৃশ্যপট।
নইলে ২০০৮-এ ঘরের মাঠে চার টেস্টের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শুরুর আগের দিন মহাষ্টমীতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই সিরিজের পর অবসর নেওয়ার ঘোষণা। কিংবা ০-৮ বিপর্যয়ের পরে মাসকয়েক আগে বোর্ড প্রেসিডেন্টকে পাশে নিয়ে রাহুল দ্রাবিড়ের অবসর ঘোষণার সাংবাদিক সম্মেলনের মতো জাঁকজমক, জৌলুস কোথায় লক্ষ্মণের আজকের সাংবাদিক সম্মেলনে? পোডিয়ামে পাশে বসা নামী মুখ শুধু এইচসিএ-র ভাইস প্রেসিডেন্ট শিবলাল যাদব। ভারতের টেস্টে অসংখ্য স্মরণীয় জয় আর রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ বাঁচানোর যুদ্ধে চিরস্মরণীয় সব ইনিংস খেলার নায়ক ভিভিএসের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর প্রেস মিট এমন নিরামিষ দেখাবে কেন? মামুলি গোটা দুই পুষ্পস্তবক তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল। পর্দায় ইডেনের ২৮১-র রূপকথার ভিডিও শো-ও সে রকম আবেগ তৈরি করতে পারল কই? কারণ ভারতীয় ক্রিকেট মহাকাব্যে ভ্রাতা লক্ষ্মণ কোনও দিনই ‘হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা’ নন। যাঁর পিছনে জনতা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটবে। শনিবারের নিস্তরঙ্গ হায়দরাবাদে উপ্পল স্টেডিয়ামের যেন আরওই হেলদোল নেই। গুটিকয়েক ক্রিকেট কর্তা। কিছু ঠিকাদার কর্মী। যারা পরের সপ্তাহে শুরু টেস্ট ম্যাচের প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত। লক্ষ্মণের এমন বিয়োগান্ত বিদায়ের দিনেও ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ যা করার সেটা শুধু মিডিয়ার লোকজনেরই। টিভিতে লক্ষ্মণের অবসরগ্রহণের সাংবাদিক সম্মেলন কম করে চার-পাঁচটা নিউজ চ্যানেল লাইভ কভার করল। স্টেডিয়াম চত্বরে এক ঝাঁক ওবি ভ্যান। কিন্তু সেই লাইভ প্রোগ্রাম ক’জন ক্রিকেটপ্রেমী দেখেছেন সন্দেহ আছে!
লক্ষ্মণ ব্যাখ্যা দিলেন, “কোনও আক্ষেপ ছাড়াই, যথেষ্ট আনন্দ নিয়ে আজ অবসর নিতে পারছি এই কারণে যে, ভারতের হয়ে ষোলো বছর যে মনোভাব নিয়ে খেলেছি, ঠিক সেই মনোভাব নিয়েই অবসর নিচ্ছি। সেটা হল, আমার মনের ভেতর থেকে যেটা শুনেছি আমি ঠিক সেটাই করেছি গোটা ক্রিকেটজীবন ধরে। আজও তাই করলাম।” তার পরেও কিন্তু লক্ষ্মণের মুখে ব্যঙ্গাত্মক হাসির ঝিলিক! অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে কী বললেন, সেই প্রশ্নের জবাবে। “ধোনিকে তো পাওয়াই মুশকিল। ওকে ফোনে ধরতে পারলে আপনাদের জানাব কী কথা হল।” তার পরে লক্ষ্মণের আরও একটা পেলব ড্রাইভ। “কারওই খেলাটা ছেড়ে চলে যেতে ভাল লাগে না। কিন্তু সম্মান রাখতে যেতে হয়। তবে আমি স্বীকার করছি, ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হোম সিরিজে খেলে ওদের হারিয়ে অবসর নেব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু গত চার-পাঁচ দিন আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন দিন গিয়েছে। এমন কিছু ঘটেছে যে আমি প্রচণ্ড দ্বিধায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তটাই সবচেয়ে ঠিক বলে নিলাম।”
লক্ষ্মণের একটা ইনিংস হয়তো ইডেন দেখতে পাবে। কারণ তিনি ঠিক করেছেন রঞ্জিতে খেলবেন আর এ বার হায়দরাবাদ পড়েছে বাংলার গ্রুপেই।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.