|
|
|
|
সদাহাস্যময়ের অবসর অনন্ত অভিমান বুকে নিয়ে |
ক্রিকেটমহলের জোর গবেষণা লক্ষ্মণের টাইমিংয়ে গণ্ডগোল হল |
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
যদি মনে করেন সে দিন ৩৫ রানে আউট হয়ে যাওয়া ভিভিএস লক্ষ্মণ জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক স্ট্রোক খেলেন ২৭ জানুয়ারির অ্যাডিলেড ওভালে, তা হলে ভুল করবেন!
ভিভিএস লক্ষ্মণ জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক স্ট্রোক খেললেন এই শনিবার সকালে। যখন ফোন তুলে চেন্নাইতে থাকা মুখ্য নির্বাচক কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তকে জানিয়ে দেন, আর খেলব না। এমনকী নিউজিল্যান্ড সিরিজও খেলব না।
বিস্ফারিত শ্রীকান্ত জানতে চান, সে কী কথা! আমরা ন’দিন আগে টেস্ট দল নির্বাচন করেছি। তুমি সেখানে আছ। এখন হঠাৎ সরে যাবে কেন?
লক্ষ্মণ বলেন, “আমি মানসিক ভাবে অত্যন্ত আপসেট। মিডিয়ায় কিছু প্রাক্তন ক্রিকেটার আমার সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছে। যে ভাবে বলেছে আমি একটা বুড়োধাড়ি, তরুণদের জায়গা আটকে দাঁড়িয়ে আছি। তার পর আর খেলা চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা আমার নেই।”
এই কথোপকথন লোকচক্ষুর অন্তরালে। লোকচক্ষুর সামনে যেটা ঘটল—সাংবাদিক সম্মেলনে বসেই বেঙ্গিপুরাপ্পু বেঙ্কটসাই লক্ষ্মণ শুরু করলেন স্বভাববিরুদ্ধ কর্কশ ভঙ্গিতে। তাঁর ক্রিকেটে, তাঁর ব্যবহারে একটা আলাপ তার পর ঝালা, এই ব্যাপারগুলো অনিবার্য ভাবে থাকে। আজ নেমেই অদ্ভুত সহবাগোচিত। প্রথম সেনটেন্স—“আয়্যাম রিটায়ারিং উইথ ইমিডিয়েট এফেক্ট। আমি অবিলম্বে অবসর নিচ্ছি।”
অথচ শনিবার ভারতের যাবতীয় মিডিয়া, কী ইলেকট্রনিক, কী প্রিন্ট গবেষণা করেছে নিউজিল্যান্ড সিরিজের ক’টা টেস্ট ম্যাচ খেলে লক্ষ্মণ অবসর নেবেন? একটা খেলবেন, না দু’টো? কারও খবরই যে মিলবে না। লক্ষ্মণ যে এমন একটা বিয়োগান্ত চমক দিয়ে যাবেন, কে জানত! সকালে কাগজ পড়েও জাতীয় নির্বাচকদের লক্ষ্মণের অবসর নিয়ে কোনও অশান্তি ছিল না। তাঁরা জানতেন, কাগজ যা-ই লিখুক, লক্ষ্মণ দু’টো টেস্ট ম্যাচই খেলবেন। তিনি তো কথা দিয়েছেন শ্রীকান্তকে। তা ছাড়া টেস্ট টিম বাছা হয়ে গিয়েছে এত দিন হল। আপত্তি থাকলে তো আগেই জানাতেন। ফিটনেস নিয়ে ফিজিও-র সন্তোষজনক রিপোর্টও পেয়েছেন তাঁরা। সেটা এমনি এমনি আসেনি। ফিটনেস নিয়ে প্রচুর খেটেওছেন লক্ষ্মণ। টানা গত তিন মাস ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে প্র্যাক্টিস করেছেন। ক’দিন আগে অফিসের কাজে বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন অন্যতম নির্বাচক রাজা বেঙ্কট। হঠাৎ লক্ষ্মণের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাঁর। ‘এখানে কী করছ’-র উত্তরে লক্ষ্মণ জানান, ট্রেনিং করছি টেস্টের জন্য। ক্রিকেট খেলতে শুরু করেনি এমন কিশোরও বলে দেবে, টানা তিন মাস ট্রেনিং কেউ অবসর নেওয়ার ঘোষণার জন্য করে না। |
|
চিরজীবন লক্ষ্মণের প্রসিদ্ধি স্ট্রোকের টাইমিংয়ের জন্য। তিনি বরাবরই সেই ঘরানার, যাঁর পা যায় না, অথচ বল বাউন্ডারিতে ছোটে। যাঁর এমসিসি ম্যানুয়ালের সঙ্গে বন্ধুত্ব নেই। অথচ চরমতম চাপে কঠিনতম প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ব্যাট হাতে বারবার তিনি মেঘনাদ-বধে সফল। তাঁর গহন-রহস্য লুকিয়ে আছে ঈশ্বরদত্ত টাইমিংয়ে। ব্যাট হাতে টাইমিং, তোমার আর এক নাম লক্ষ্মণ!
ঘটনাচক্রে এ দিন তাঁর হায়দরাবাদস্থিত সাংবাদিক সম্মেলন শুরু হল ঠিক ৪৩ মিনিট দেরিতে। শুরুর দিকে মাইক কাজ করছিল না। প্রথম বাক্যটা বলার পরেই ভিডিও-র লাইন কেটে আঁধার নেমে এল। তিনটে আইটেমই লক্ষ্মণের সঙ্গে যায় না। রাহুল দ্রাবিড় অবসরের দিনেও নিখুঁত টাইমিং করেছেন। তিনিলক্ষ্মণ তাঁর চিরাচরিত ‘টাচ’টা ক্রিকেটজীবনের শেষ দিনে অদৃশ্য হয়ে যাবে কেন?
এই হেঁয়ালির উত্তর খোঁজার চেয়ে বিস্ফারিত ভারতীয় ক্রিকেটমহল আরও বড় জিজ্ঞাসা কোলে নিয়ে বসে রয়েছে। জীবনের শেষ আন্তর্জাতিক স্ট্রোকের টাইমিংটা ঠিক হল?
এত অভিমান না করে কি প্র্যাকটিক্যাল হওয়া উচিত ছিল না লক্ষ্মণের? তাঁর বদলি হিসেবে যে টিম ম্যানেজমেন্ট বদ্রিনাথের নাম প্রস্তাব করেছে। কয়েক জন নির্বাচকও আহ্লাদের সঙ্গে লক্ষ্মণের বদলি হিসেবে মনোজের আগে বদ্রিনাথকে চাইছেন, তা আমক্রিকেটমোদীর অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। ভারতীয় ক্রিকেটের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত কারও লাগবে না। তাঁরা জানেন, ক্যাপ্টেন-কোচ-নির্বাচক সবাইকে চেন্নাই লাইন নিতেই হবে।
সেটা তো নাহয় সহজবোধ্য। কিন্তু লক্ষ্মণ, এত দিনের পোড় খাওয়া তিনি বিদায়বেলায় এত রাগী হয়ে গেলেন কেন?
তাঁর রাগ অবশ্যই নির্বাচকদের ওপরে। তিনি খেলতে চেয়েছিলেন পুরো ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া সিরিজ। যাতে গত বছরের ০-৮-এর বদলা নেওয়ার অভিযানে টিম ইন্ডিয়ার কৃতী সৈনিকের ভূমিকা নিতে পারেন। প্রধান নির্বাচক উল্টে তাঁকে বলেন, মানে মানে দু’টো খেলে কেটে পড়ো। এর পর কী হবে গ্যারান্টি দিতে পারছি না। মনে হয়, ওরা তোমায় বাদ দিয়ে দেবে।
তাঁর অভিমান অবশ্যই টিম ম্যানেজমেন্টের ওপরেও। নির্বাচকেরা ধোনিকে বলেছিলেন লক্ষ্মণের সঙ্গে তাঁর ক্রিকেট-ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে। ধোনি আর ফ্লেচার যদি তাঁকে মনোবল জোগাতেন। যদি পাশে থেকে জোর দিয়ে বলতেন, কোন এক্স প্লেয়ার কী বলছে ছেড়ে দাও। কোন মিডিয়া কী লিখছে ছেড়ে দাও। কোন নির্বাচক কী ভাবছে মাথা ঘামিও না। আমাদের তোমাকে দরকার। তুমি ছাড়া হবে না। তা হলে লক্ষ্মণ অবশ্যই থেকে যেতেন। ঘটনা হল, ধোনিরা কেউ একটা ফোনও করেননি। উল্টে লক্ষ্মণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ধোনিকে নিজে জানাতে চান। তখনও হয়তো সিদ্ধান্ত বদলানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু ধোনিকে বরাবরের মতো ফোনে ধরাই যায়নি।
লক্ষ্মণ-ঘনিষ্ঠ এক ক্রিকেট কর্তা এ দিন দিল্লি থেকে ফোনে বললেন, “স্ট্রোকে গণ্ডগোল করে ফেলল। ভিভিএস লক্ষ্মণ তো বরাবরই নিজের দয়ায় ক্রিকেট খেলেছে। কেউ ছিল না ওর পাশে। আজ বিদায়বেলায় হঠাৎ পাশে কাউকে না পেয়ে অভিমান করতে গেল কেন? এতে কার কী লাভ হল? খুব খারাপ সিদ্ধান্ত।”
লক্ষ্মণ নিজে সাংবাদিক সম্মেলনে কোনও কাদা ঘাঁটা বা কচকচিতে যাননি। বরঞ্চ বলেন, গত চার-পাঁচ দিনে মনের মধ্যে থেকে নির্দেশ পেয়েছেন আর খেলার প্রয়োজন নেই। বলেন, যে আদর্শ নিয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছিলাম, সেই আদর্শ নিয়েই শেষ করলাম। এ সব শুনেটুনে প্রেস কনফারেন্স শেষ হওয়া মাত্র খুব পরিচিত তাঁর শহরের এক সাংবাদিক অবাক হয়ে এগিয়ে যান। বলেন, “সে কী! দু’দিন আগেও তো তুমি বললে অস্ট্রেলিয়া খেলে শেষ করবে।” লক্ষ্মণ মাথা নাড়েন। বলেন, “মনটাই ভেঙে গিয়েছে আমার।”
এই মন্তব্য থেকে আরও পরিষ্কার শনিবারের কঠিন সিদ্ধান্ত বিরোধীদের বিরুদ্ধে লক্ষ্মণের চূড়ান্ত স্ট্রোক। আমাকে নিয়ে তোদের অ্যাতো গায়ের জ্বালা ছিল তো, চল আমি সরেই যাচ্ছি। এ বার মজাটা দেখবি।
সাম্প্রতিক কালের ভারতীয় ক্রিকেটে নির্বাচিত হয়ে কেউ এ ভাবে ছেড়ে দিয়েছে এমন তুলনাই নেই। এ সব হত পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে নেহরুর ভারতে। রাহুল গাঁধীর ভারত এ ভাবে টিম থেকে ওয়াকআউট করার সঙ্গে পরিচিত নয়। তা-ও এর সঙ্গে জড়িয়ে এমন একজন যাঁকে ড্রেসিংরুমের বাইরের পৃথিবী পিকচার-পারফেক্ট বলে জানে। এক এক সময় মনে হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে ড্রেসিংরুমের লক্ষ্মণ জনসমক্ষে দেখা দিলেন। সৌরভ-সহ তাঁর সতীর্থরা বারবার বলেছেন, মাঠের লক্ষ্মণকে দেখে ড্রেসিংরুমের লোকটাকে বোঝা যাবে না। ড্রেসিংরুমের লোকটা আমুদে। মজা করে ডাকা হয় লাচ্ছুভাই। কিন্তু মারাত্মক একরোখা। মর্যাদায় ঘা পড়লে ফোঁস করে ওঠে। অসম্ভব তেজি আর আক্রমণাত্মক যেটা সব সময় মুখে লেগে থাকা হাসিতে ক্যামোফ্লেজ হয়ে যায়। এই লোকটাই কিনা সাইমন্ডস বনাম হরভজন ঝগড়ার সময় গোটা ড্রেসিংরুমকে তাতিয়েছিল! নেতৃত্ব দিয়েছিল অজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আন্দোলনে!
ড্রেসিংরুমের লক্ষ্মণই কি শেষ বেলায় নিজ-বেশে ড্রেসিংরুমের বাইরে আবির্ভূত হলেন? বেশি আক্রমণাত্মক হতে গিয়েই কি তাঁর স্ট্রোকে গণ্ডগোল হল? এর পরে যে শেষ মহীরুহ চলে যাবে, তাঁর আদ্যক্ষর ‘এসআরটি’। কিন্তু কবে যাবেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর?
লক্ষ্মণের শক্তিশেল চিরকাল ভারতীয় ক্রিকেটের সমস্যা সমাধান করেছে। এ বার উল্টোটা হল। খুলে দিয়ে গেল অবিশ্রান্ত প্রশ্নের বাঁধ।
|
• হায়দরাবাদে যখন খেলতে নামব, একটা গভীর শূন্যতা বোধ করব। এই শূন্যতা কখনওই ভরাট হবে না। আমি যাদের সঙ্গে খেলেছি, তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা প্লেয়ার। ভারতীয় ক্রিকেটেরও। আমার প্রিয় বন্ধু, ভিভিএস লক্ষ্মণ....আর আমার পাশে নেই। একজন নিখাদ ভদ্রলোক এবং খেলাটার অন্যতম লেজেন্ডের সঙ্গে আমার কিছু সেরা ক্রিকেটীয় মুহূর্ত কাটাতে পেরেছি ভেবে দারুণ লাগছে। ভিভিএস, গোটা দল এবং আমি তোমাকে মিস করব।
সচিন তেন্ডুলকর |
• পুরো টিম তোমাকে মিস করবে। আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা মানুষ। মাঠে ওর সঙ্গে ব্যাটিং এবং ফিল্ডিং করতে গিয়ে যখনই অনেকটা সময় কাটিয়েছি, তখনই অবশ্যম্ভাবী টিম নিয়ে কথা হয়েছে। যখনই কেক কাটব ওকে মিস করব। ব্যক্তিগত ভাবে সত্যিই মিস করব লাচ্চু ভাই।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি |
• অর্জুন পুরস্কার পাচ্ছি বলে ভীষণ সম্মানিত। কিন্তু ভিভিএস অবসর নিল বলে খুব খারাপ লাগছে। আশা করেছিলাম, ও বছরের শেষ পর্যন্ত খেলবে। সবথেকে ভাল একটা মানুষ। সোনার হৃদয়। একজন পুরোদস্তুর টিম ম্যান। যখনই ভারতের প্রয়োজন হয়েছে, তখনই লক্ষ্মণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। একজন গ্রেট ক্রিকেটার, লেজেন্ড, বিশেষ বন্ধু। ডিয়ার ভেরি ভেরি স্পেশাল, তোমাকে মিস করব।
যুবরাজ সিংহ |
• বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর কব্জি আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলবে না। ভিভিএস আর ওর পরিবারের প্রতি শুভেচ্ছা রইল।
রাহুল দ্রাবিড় |
• ক্রিকেট মাঠে যে-সব ভদ্রলোককে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম সেরা ভিভিএস। ভারতীয় দলের স্তম্ভ আর সত্যিকারের বন্ধু। যা বোঝানোর জন্য কোনও শব্দই যথেষ্ট নয়।
বীরেন্দ্র সহবাগ |
• খুব কম ক্রিকেটারই ব্যাটিংকে এত সহজ করে দেখিয়েছে। লক্ষ্মণ এমন ক্রিকেটার যে চাপে সফল হয়েছে। ওর যে সব ক্লাসিক ইনিংস আছে তা দলকেই বিপদ থেকে উদ্ধার করেনি, ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসকেও প্রভাবিত করেছে।
এন শ্রীনিবাসন |
|
|
|
|
|
|