বনবাস বেছেই মোক্ষম জবাব
অভিমান সঙ্গী করে সরে
গেল হারাধনের আর এক ছেলে
ছোটবেলায় এই কবিতাটা পড়েননি, হেন লোক বোধহয় বাংলায় নেই। হারাধনের দশটি ছেলে।
হারাধনের এ রকমই পাঁচটি ছেলে ছিল ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমে। হারাধন ধরে নেওয়া যাক ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড। একটি ছেলে কাঠ কাটতে গিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। একটা যায় বাঘের পেটে। একটা চলে গিয়েছিল বনে। একটি ম’ল আছাড় খেয়ে। আপাতত পড়ে রইল মাত্র এক ছেলে। যে দেশবাসী এবং হারাধনের সবচেয়ে প্রিয় ছেলে। সে কবে ক্রিকেট থেকে সরে যাবে, তা নিয়ে এ বার মানুষের মনে প্রশ্ন শুরু হবে। আপাতত থাক সেই আলোচনা।
এখন অবশ্য যে ছেলেটি এ দিন চলে গেল, তাকে নিয়েই কথা বলি। এই ছেলেটির হারাধনের ওপর প্রচুর রাগ ছিল। মজার কথা হল, এই ছেলেটার আবার ভাইয়েদের ওপরও প্রচণ্ড অভিমান ছিল। সময়-সময় ভাইদের ওপর খুব রাগ করত। ভাইরা নাকি তাকে ঠিক ঠিক সময় দেখেনি।
ভিভিএস লক্ষ্মণ নিয়ে বিয়োগ-গাথা লিখতে গিয়ে প্রথমে ভাইদের ওপর প্রচণ্ড অভিমানটার কথাই মনে পড়ল।
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজের দলে নির্বাচিত হওয়ার পরেও লক্ষ্মণ যে ভাবে সরে দাঁড়াল, তাকে আমি পুরোপুরি সমর্থন করি। লক্ষ্মণের মতো ক্রিকেটারের ‘ফেয়ারওয়েল’ সিরিজ একেবারেই দরকার নেই। আমি জানি, প্রধান নির্বাচক হিসেবে শ্রীকান্তের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। তবু নির্বাচকদের বলব, ক্রিকেটারদের সঙ্গে আপনারা যা খুশি তাই করতে পারেন না। এক জন ক্রিকেটারকে যদি খারাপ ফর্মের জন্য বাদ দেওয়া হয়, তা হলে সেই নিয়মটা যেন বাকিদের ক্ষেত্রেও নিয়োগ করা হয়। অস্ট্রেলিয়া সিরিজের যদি স্কোরবোর্ড খোলা হয়, তা হলে দেখা যাবে, অনেকেই কিন্তু পারফর্ম করেনি। গৌতম গম্ভীর করেনি।
সুরেশ রায়না করেনি। সহবাগ করেনি। স্বয়ং ধোনি করেনি। যে উইকেটে সবুজ ছাড়া কোনও রং নেই, সেখানেও অত্যন্ত খারাপ বল করেছে ইশান্ত শর্মা। তারা সবাই কি না ০-৪-এর পরেও বহাল তবিয়তে টিমে থেকে গেল। আর লক্ষ্মণকে ধরানো হল চরমপত্র যে, দুটো টেস্ট খেলো। তার পরে সরে যাও। এই অপমান মোটেও ওর প্রাপ্য ছিল না। আমার মনে হয়, আজকের সিদ্ধান্তে নির্বাচকদেরই একটা কড়া বার্তা পাঠাল লক্ষ্মণ: তোমরা যাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পার না।
ভারতীয় ক্রিকেটের সব চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ঠিকঠাক নির্বাচক কমিটি তৈরি করতে না পারা। এখনকার নির্বাচক কমিটির যোগ্যতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। লক্ষ্মণের সঙ্গে নির্বাচকরা যে ব্যবহার করল, ১৩৪ টেস্ট ম্যাচ খেলা এক জন প্লেয়ার তার দেশের কাছে এই ব্যবহার অবশ্যই প্রত্যাশা করে না। পাঁচ নির্বাচকের মোট রানসংখ্যা লক্ষ্মণের চেয়ে কম। মিলিত ভাবেও ওর চেয়ে কম টেস্ট ম্যাচ খেলেছে।
ভিভিএস-কে প্রথম দেখি হেডিংলে ড্রেসিংরুমে। ১৯৯৬ ইংল্যান্ড সফরে তখন ভারত একটা ওয়ান ডে খেলছিল। যে ম্যাচে আমি দলে ছিলাম না। এমনিতে লক্ষ্মণের সঙ্গে জুনিয়র পর্যায়ে খেলিনি। যাকে বলে এজ-গ্রুপ ক্রিকেট। অবশ্য ভারতীয় ক্রিকেটে সবাইকেই তো আমার থেকে কমবয়সি মনে হয়! না, ভুল বললাম। শুধু ভারতে কেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও যেন আমি সব চেয়ে বেশি বয়সি। ১৯৯৬ সালে অভিষেক হওয়া আব্দুর রজ্জাকের বয়স তো দেখি এখনও ৩২!
আমার অঙ্ক ঠিক হলে রজ্জাক ১৬ বছর বয়সে পাকিস্তানের হয়ে খেলা শুরু করেছিল!
যাক গে, আমদাবাদের ধুলো ভরা পিচে ১৯৯৬ সালে অভিষেক টেস্টে অসাধারণ একটা ইনিংস খেলে ম্যাচ জিতিয়েছিল লক্ষ্মণ। প্রথম বার ওকে দেখেই মনে হয়েছিল যেন আজহারউদ্দিন। কব্জির মোচড়ে দু’জনের মিল থাকলেও খুব তাড়াতাড়ি প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল, আজহারের চেয়ে লক্ষ্মণের টেকনিক অনেক বেশি মজবুত। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের জন্য অসাধারণ ম্যাচ উইনার ছিল লক্ষ্মণ। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা নিশ্চয়ই ওর প্রতিটা ইনিংস দেখেছেন। কিন্তু আমার কাছে ২০০১-এর ইডেনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ইনিংসটা সব সময় আলাদা গুরুত্ব পাবে। আমি বরাবর বিদেশে জেতা, বিদেশে বড় রান করাকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। কিন্তু ইডেনে ২৮১ রানের ইনিংসটা শুধু লক্ষ্মণেরই সেরা ইনিংস নয়, টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেঞ্চুরি। ওই ইনিংসটা ম্যাচ আর সিরিজের মোড় আমাদের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ভারতীয় ক্রিকেটে একটা বিশাল যাত্রার সূচনা করেছিল। আমরা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম যে, ঘরের মাঠে তো বটেই, বিদেশেও ভারত জিততে পারে। তাই বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।
লক্ষ্মণের অবসর ঘোষণার মুহূর্তে স্ত্রী শৈলজা। শনিবার হায়দরাবাদে। ছবি: এএফপি
লক্ষ্মণ প্রচুর ভাল ইনিংস খেলেছে। সব ইনিংসের ব্যাখ্যা করতে যাওয়া তাই অসম্ভব। তবে ২০০০ সিডনি, ২০০৩ অ্যাডিলেড, ২০১০ ডারবান, মোহালি এগুলো ‘ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল’ ইনিংস। কারণ ওই ইনিংসগুলোর পরেই বঙ্গিপুরাপ্পু বেঙ্কট সাই লক্ষ্মণ থেকে ওর নাম হয়ে গিয়েছিল ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল লক্ষ্মণ। অবসর নেওয়া কোনও খেলোয়াড়ের সম্পর্কে লিখতে বসে অনেকেই বলেন, মানুষ হিসেবে সেই লোকটা কত ভাল ছিল। লক্ষ্মণ এমন এক জন মানুষ, যার সম্পর্কে আমি হলফ করে বলতে পারি, এই লোকটা মাঠের বাইরেও একশো শতাংশ ‘জেন্টলম্যান’ ছিল। খাঁটি নিরামিষাশী লক্ষ্মণ রসম আর দই ভীষণ ভালবাসে। তা বলে ভাববেন না ওর মানসিক আগ্রাসন বা শক্তি কিছু কম ছিল।
এখনও মনে আছে সিডনি টেস্টের কথা। সিরিজের শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসের আগে ওই সময়টা লক্ষ্মণের জন্য খুব খারাপ যাচ্ছিল। টেস্ট আর ওয়ান ডে দল থেকে বাদ পড়ার চিন্তা ঘোরাফেরা করছিল ওর মাথায়। তখনও জানত না, পরের দিনই নিজের অন্যতম সেরা ইনিংসটা খেলবে। যেটা ওর কেরিয়ারের চেহারাই পাল্টে দেবে। ওই দিনের পর থেকেই লক্ষ্মণের মন থেকে নেতিবাচক সব ব্যাপার বেরিয়ে গিয়েছিল। এই কারণেই ভারতীয় ক্রিকেটে এত লম্বা সময় ধরে অবদান রাখতে পেরেছে ও। তবে হ্যাঁ, দেশের হয়ে বিশ্বকাপ না খেলার দুঃখটা ওর থেকেই গিয়েছিল। সেটা স্বাভাবিক।
আপনারা টিভিতে যে লক্ষ্মণকে এত বছর দেখে এসেছেন আর ড্রেসিংরুমে যাকে আমরা কাছ থেকে দেখতাম, দুটো লোক সম্পূর্ণ আলাদা। ড্রেসিংরুমের লক্ষ্মণ অনেক প্রাণচঞ্চল। সারাক্ষণ ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু জাহির খানের পেছনে লাগছে। টিমকে চাগাচ্ছে। কিন্তু সব সময়ই খুব স্লো। আমি লক্ষ্মণকে বলব ইনজামাম-উল-হকের গতিশীল সংস্করণ। দু’জনের মিল হল, দু’জনেই পেস বোলিং অসম্ভব ভাল খেলে।
ড্রেসিংরুমে ব্যাট করতে যাওয়ার আগে লক্ষ্মণের মতো আলসে মেজাজ আমি কারও দেখিনি। বিশ্ব ক্রিকেটে গত কুড়ি বছরে এ রকম কেউ এসেছে কি না সন্দেহ। আমি ব্যাট করতে যেতাম পাঁচ নম্বরে। লক্ষ্মণ ছয়ে। প্যাড পরে নামার সময় কখনও দেখিনি, পরের ব্যাটসম্যান হিসেবে ও রেডি হয়ে রয়েছে। বরঞ্চ উল্টোটাই দেখতাম। ও চান করতে যাচ্ছে। এক বার কেপটাউন টেস্টে ওর যাওয়ার কথা ছিল চার নম্বরে। সচিন দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসের অনেকটা সময় বাইরে ছিল বলে ব্যাট করার অনুমতি পায়নি। থার্ড আম্পায়ার ওকে মাঠে ঢোকার মুখে আটকে দেন। তখন হুড়মুড় করে লক্ষ্মণকে পাঠানোর তোড়জোড় হয়। কিন্তু কোথায় লক্ষ্মণ? সে তো তখন শাওয়ারে! বাধ্য হয়ে আমাকে চার নম্বরে যেতে হয়। আমার এক পায়ের প্যাড পরিয়েছিল সচিন। এক পায়ের সহবাগ। আর জুতোর ফিতে বেঁধে দেয় ফিজিও। আমার দুটো হাত তখন শার্ট বদলানোয় ব্যস্ত ছিল।
এগুলো এখন সবই স্মৃতি হয়ে গেল। লক্ষ্মণও আমার, রাহুলের বা কুম্বলের মতো চলে গেল ক্রিকেট ইতিহাসের স্কোরবোর্ডে। টেস্ট ক্রিকেট খেলতে আর ও মাঠে নামবে না। একটাই কথা ওকে আমি বলতে পারি। এখন থেকে নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি আসবে। যেটা শব্দে ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। এই অনুভূতিটা হল, জীবনে যেটা করতে আমার সব চেয়ে ভাল লাগত সেটাই আমার কাছ থেকে সরে গেল। ভিভিএস, একটাই পরামর্শ তোকে। যত তাড়াতাড়ি এই ব্যাপারটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবি ততই তোর পক্ষে মঙ্গল।

লক্ষ্মণের শক্তিশেল
টেস্ট
• ম্যাচ ১৩৪
• ইনিংস ২২৫
• রান ৮৭৮১
• সর্বোচ্চ ২৮১
• গড় ৪৫.৯৭
• সেঞ্চুরি ১৭
• হাফসেঞ্চুরি ৫৬
• টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২৪৩৪
সেরা পাঁচ ইনিংস
• ১৬৭ বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া, সিডনি, ২০০০
• ২৮১ বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া, ইডেন গার্ডেন্স, ২০০১
• ৬৯ ন.আ. বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পোর্ট অফ স্পেন, ২০০২
• ৭৩ ন.আ. বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া, মোহালি, ২০১০
• ৯৬ বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা, ডারবান, ২০১০




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.