তাঁর আগেও আদিবাসীদের ছবি উঠেছে, কিন্তু সে কেবল ‘চেহারা ওঠানো’।
সম্প্রতি প্রয়াত আলোকচিত্রী সুনীল জানার কথা লিখছেন আশিস পাঠক |
একটি চুলের কাঁটার জন্যই ডাকটিকিট হতে গিয়েও বাতিল হয়ে যাচ্ছিল এক আদিবাসীর ছবি। ডাকটিকিটে ছাপার জন্য এক আলোকচিত্রী জমা দিয়েছিলেন তিনশো ছবি। নির্বাচিত হয়েছিল ছ’টি। কিন্তু বেঁকে বসলেন সরকারি নৃতাত্ত্বিক। বললেন, এ তো আদিবাসীর ছবি নয়, অন্য মেয়েকে সাজিয়ে তুলেছে স্টুডিয়োয়। কেন? সেই কাঁটাটা নেই যে। আইভরির চুলের কাঁটা ওই আদিবাসীরা পরবেই, সেটা কই? আলোকচিত্রী বোঝালেন, কাঁটাটা আছে, কিন্তু মেয়েটি মাথার কাছে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় দেখা যাচ্ছে না। ভবী ভুলল না। শেষে ভেরিয়ার এলুইনের বই নিয়ে গিয়ে সেই ছবিটাই দেখাতে নৃতাত্ত্বিক বিশ্বাস গেলেন।
এই লড়াইটা যাঁকে করতে হয়েছিল, তিনি সদ্য-প্রয়াত সুনীল জানা। ১৯৪০-এর মাঝামাঝি থেকে প্রায় তিন দশক যিনি ভারতের নানা প্রান্তের আদিবাসীদের সঙ্গে থেকেছেন, ছবি তুলেছেন। তাঁর আগেও এ দেশের আদিবাসীদের ছবি তোলা হয়েছে। কিন্তু তা কেবল ‘চেহারা ওঠানো’, ‘এথনোলজিকাল ডকুমেন্টেশন’। তার অধিকাংশেই, জীবন, ‘স্লাইস অব লাইফ’, নেই।
ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি, ভারতে ফোটোগ্রাফির সেই আদি যুগে চিনাবাজার, রাধাবাজার অঞ্চলে ঘুরত আলোকচিত্রীর দালালেরা। হাতে ছোট ছোট ফোটো নিয়ে পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোক দেখলেই প্রশ্ন করত, ‘মশাই, চেহারা উঠাইবেন? চারি আনা দিলেই চমৎকার চেহারা হইবে।’ তার পরে বহু বছর পেরিয়েছে। বক্স ক্যামেরা থেকে ডিজিট্যাল ছবি তোলার প্রযুক্তি আর শিল্প প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। কিন্তু শিল্পীর অধিকার আর সম্মান? এখনও সেই তিমিরেই।
|
হাঁড়ি শূন্য, দৃষ্টিও। দুর্ভিক্ষ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ১৯৪৫।
সৌজন্য: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস |
কোন তিমিরে? গত ২১ জুন বার্কলেতে ৯৪ বছর বয়সে প্রচারের আলোর আড়ালে মৃত্যু হল যে প্রবাসী ভারতীয় আলোকচিত্রীর, সেই সুনীল জানা মৃত্যুর আগেও সাক্ষাৎকারে অভিমান প্রকাশ করেছিলেন, বিনা অনুমতিতে বিনা স্বীকৃতিতে তাঁর তোলা ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায় তিরিশ বছর আগে, সিদ্ধার্থ ঘোষকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও উদাসীন অভিমানে বলেছিলেন তিনি, ‘আমার ছবি আগেও অন্যের নামে বেরিয়েছে, এ নিয়ে অবশ্য আমার মাথাব্যথা নেই।’
মাথাব্যথা না-থাকারই কথা। শিল্পী কাজ করবেন, চোরেদের পিছনে ছুটবেন কেন? ছ’দশকেরও বেশি সেই কাজের জীবন, ক্যামেরা-জীবন সুনীল জানার। প্রবাসে, আশি বছর পেরিয়েও পথে নেমেছেন ৯/১১ পরবর্তী আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনের ছবি তোলার টানে।
নেশাটা ধরিয়েছিলেন শম্ভু সাহা। দিদিমার উপহার ভয়েগল্যান্ডার ব্রিলিয়ান্ট সেভেন পয়েন্ট সেভেন ক্যামেরা দিয়ে শুরু করেছিলেন। বয়স তখন দশ-এগারো। তার পরে ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’তে ছবির প্রকাশ এবং পুরস্কার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সিপিআই-এর স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সদস্য হলেন। কিন্তু সে, তাঁর নিজের কথাতেই, ‘লুজলি কানেক্টেড উইথ দ্য পার্টি অবশ্য তখন আমার বেশির ভাগ কাজই ছিল ওই ক্যুরিয়র গোছের।’ সম্পর্ক পরে আরও ঘনিষ্ঠ হবে, ‘পিপলস ওয়ার’ আর ‘জনযুদ্ধ’-এর ফোটো-এডিটর হবেন তিনি। আরও পরে সম্পর্ক ছিন্ন হবে দলের সঙ্গে। পার্টির কাগজে খবর বেরোবে, সুনীল জানাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কিন্তু এ সব নিছক তথ্য। ছাতের পড়ার ঘরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আসা আলোর জ্যামিতি ক্যামেরায় ধরে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল যে কিশোর তাকে পথে নামাবেন পূরণচাঁদ জোশি। ১৯৪৩, বাংলায় দুর্ভিক্ষ। জোশি এলেন কলকাতায়, তরুণটিকে বললেন, ‘কাম ডাউন উইথ মি অ্যান্ড টেক ফোটোগ্রাফস।’ সেই শুরু। তার পরে বাংলা-ওড়িশার দুর্ভিক্ষ তো বটেই, ১৯৪৫-এ দক্ষিণ ভারতের দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, দাঙ্গা, ইউ এন ও-র কমিশনে মায়ানমার, মালয় এবং তাইল্যান্ড... মানুষের ছবি, জীবনের ছবি তুলে গিয়েছেন এই পদাতিক। এমনকী, মুম্বইয়ের নৌ-বিদ্রোহ। সেই ছবির গল্প বলেছেন নিজে, ‘ঐ ডেডবডিগুলো কোনো পুলিশথানার সামনে ফেলা হয় নি। দে ওয়ের হিডেন ইন আ হসপিটাল কম্পাউন্ড। আফটার শুটিং বডিগুলো কালেক্ট করেছে, কিছু অলরেডি ডেড, কিছু স্টিল অ্যালাইভ। সেগুলো হসপিটালে নিয়ে আসে। যারা সারভাইভ করে নি তাদের ওখানে পাইল্ করেছিল। সরাসরি ছবি তোলার চেষ্টা করলে আমাকেও হয়তো গুলি করত...’।
পথে মৃত্যুর সঙ্গে শুধু নয়, ঠান্ডা ঘরের আমলাতান্ত্রিক চিত্র-বুদ্ধির সঙ্গেও লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর ক্যামেরার সামনে সহজ, স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে আদিবাসীরা। সে সব ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে দিল্লিতে, উচ্চপদস্থ এক সরকারি চাকুরে এসে বললেন, ‘এগুলো ডিসগ্রেসফুল, এরকম বেয়ার ব্রেস্টেড উইমেন, এগুলো আমাদের দেশের মেয়েদের পক্ষে ভীষণ ডেরোগেটরি এগুলো এগজিবিট করার কোনো মানে হয় না, এগুলো এখানে আমরা চাই না।’
কী বলবেন আধুনিক ভারতের আলোকচিত্রী? কথা বলা যে তাঁর কাজ নয়। সৌজন্য চিনা প্রবাদ, দশ হাজার কথার সমান যে আলোছায়ার ছবি তাকে ধরাই যে তাঁর পণ। শুধু বলেছিলেন, ‘আই ডিড নট আনড্রেস দেম, দে ওয়্যার লাইক দ্যাট। আই ফোটোগ্রাফড দেম বিকজ আই টুক গ্রেট জয় ইন লিভিং উইথ দেম, অ্যান্ড আই ফাউন্ড দেম ডিলাইটফুল পিপল!’
প্রবাসে নিজের তোলা অজস্র ছবির প্রিন্ট আর নেগেটিভের মাঝে বহু ক্ষোভ আর অভিমান ছাপিয়ে ‘স্লাইস অব লাইফ’ এই আনন্দটুকুই বাঁচিয়ে রেখেছিল সুনীলকে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিতব্য তাঁর অ্যালবাম ফোটোগ্রাফিং ইন্ডিয়া-য় লিখেছেন এই আনন্দের কথাটাই, ‘আই অ্যাম নিয়ারলি ব্লাইন্ড নাউ, অ্যান্ড আই হ্যাভ নট ফাউন্ড এনি রিলিফ ফ্রম ক্রনিক পেন। বাট আই হ্যাভ হ্যাড মাই মোমেন্টস অব এক্সল্টেশন, মোমেন্টস অব গ্রেট জয়; অ্যান্ড আই অ্যাম গ্ল্যাড টু বি ইয়েট অ্যালাইভ।’ একটি চোখ ছোটবেলা থেকেই দুর্বল ছিল, শেষ জীবনে শক্তি ক্ষীণ হয়ে এল আর একটির। তার পরে চলে গেলেন অনন্ত ডার্করুমে।
দু’একটি প্রয়াণলেখ, ভুল করে দু’বার ‘পদ্মশ্রী’ দিতে গিয়ে এক বার ‘পদ্মভূষণ’, এই সব অকিঞ্চিৎকরের বাইরে আমাদের মননের ডার্করুমে আলো ক্রমে আসবে কি?
ক্যালেন্ডার বলছে, আজ, ১৯ অগস্ট, বিশ্ব ফোটোগ্রাফি দিবস! |