মহাভারতের যুগে কার্ল লুইস বা উসেইন বোল্ট ছিলেন না। থাকিলে, ধর্ম যখন যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন শব্দ অপেক্ষা দ্রুতগামী কে, তখন ধর্মপুত্র হয়তো ‘মন’ না বলিয়া এই দুই দৌড়বিদের মধ্যে এক জনের নাম বলিতেন। এই দুই জন আধুনিক কালের পবনপুত্র মারুতি। স্বয়ং পবনও তাঁহাদের নিকট দৌড়ে হারেন। এই দুই মহারথী এমনই কীর্তির মালিক যে ক্রীড়া ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাঁহাদের চিরস্থায়িত্ব বিষয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নাই। তবুও তাঁহারা পরস্পরের সহিত ঝগড়ায় মাতেন। এক জন জানাইয়া দেন, তিনি তাঁহার পূর্বসূরিকে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা করেন না। আর, জবাবে সেই পূর্বসূরি বলেন, তিনি যে কীর্তি স্থাপন করিয়াছেন, সেই কীর্তি ছুঁইবার কথাও যেন বোল্ট না ভাবেন। তাঁহাদের ঝগড়া এমন একটি বিষয়ে, যাহা ইতিমধ্যেই মীমাংসিত। এই ঝগড়ায় তাঁহাদের শ্রেষ্ঠত্বের ইতরবিশেষ হইবে না। তাঁহারা তবুও ঝগড়া করিতেছেন দেখিয়া বোধ হয়, এই ঝগড়া নেহাত ঝগড়ার আনন্দেই হইতেছে।
অর্থাৎ, ঝগড়া করিয়া নির্মল আনন্দ পাওয়া শুধু ভারতীয়দের একচেটিয়া নহে, তাহার আবেদন সর্বজনীন। যে শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ায় বাড়িতে কাক-চিল বসিতে পায় না, যে ভাড়াটে-বাড়িওয়ালার সম্পর্কটি একমাত্র ঝগড়ার তারেই বাঁধা থাকে, যে দুই টেনিস ‘তারকা’ বর্তমানে কেবলমাত্র পারস্পরিক ঝগড়ার কারণেই খবরে ঠাঁই পান, আনন্দের মাপকাঠিতে তাঁহারা উসেইন বোল্ট-কার্ল লুইসের সমান। অথবা, সামান্য হইলেও আগাইয়া আছেন। কারণ, বোল্ট-লুইসদের ঝগড়া আরম্ভ করিবার পূর্বে কিছু কীর্তি স্থাপন করিতে হইয়াছিল। আমাদের সেই দায় নাই। আমাদের ঝগড়ার আনন্দ তাই নির্মল। ইস্টবেঙ্গল না মোহনবাগান, শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা কাহার প্রাপ্য, সেই ঝগড়ায় গলা না ফাটাইলে নাকি বাঙালিত্ব (অথবা, বাঙালত্ব) সম্পূর্ণ হয় না। ফলে, সারা জীবনে কোনও দিন ফুটবলে পা না ছোঁওয়াইয়াও বাঙালি চায়ের দোকানে তারস্বরে এই তর্ক করিয়াছে।
সত্য বলিতে কী, এই চায়ের দোকান শহুরে বাঙালির ঝগড়ার পীঠস্থান, প্রাচীন চণ্ডীমণ্ডপের যোগ্য উত্তরসূরি। বলা চলে, কৃষি হইতে শিল্প, গ্রাম হইতে শহর, চণ্ডীমণ্ডপ হইতে চায়ের দোকান ইহাই তো উন্নয়ন। ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র হইতে উত্তমকুমার বনাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সকল তর্কের ময়দান এই চায়ের দোকান। এক নাগরিক কবিয়াল লিখিয়াছিলেন, কোনও তর্কেরই মীমাংসা আজ চাহি না। প্রকৃতার্থে, কোনও তর্কেরই মীমাংসা হয় না। হয় না বলিয়াই তাহার আবেদন এমন অমোঘ, যে কোনও দিন যে কোনও তর্কের সুতা নূতন করিয়া তুলিয়া লওয়া যায়। সেই ঝগড়ায় পক্ষ পাল্টাইয়া যায়, আজ যে লাল, কাল তাহাকে হয়তো সবুজের হইয়া গলা ফাটাইতে দেখা যাইবে। তবু ঝগড়া টিকিয়া থাকে। তবে, উচ্চৈঃস্বরে চলিতে থাকা ঝগড়াও কী ভাবে থামিয়া যাইতে পারে, সুকুমার রায় জানিতেন। বাঙালির ঝগড়ার ভাগ্যক্রমে সুকুমার-বর্ণিত পন্থাটি বিশেষ ব্যবহৃত হয় না, তাহাই যা রক্ষা। |