লন্ডনে ভারত হকিতে আট-নয়ের ওপরে উঠবে না ধরেই নিয়েছিলাম। ফলে ভরত ছেত্রীরা বারোয় শেষ করায় অত্যাশ্চর্য হয়েছি বললে মিথ্যে বলা হবে। তবে কিছুটা অবাক আর প্রাক্তন হকি অলিম্পিয়ান হিসেবে দুঃখ পেয়েছি তো বটেই। শনিবারই সকালে লন্ডন থেকে মুম্বই ফিরেছি। অলিম্পিকে আমাদের টেনিস দলের সঙ্গেই প্রায় সারাক্ষণ ছিলাম বলে ভারতের হকি ম্যাচের পাস জোগাড় করার সময় পাইনি। তবে আমার লন্ডনের দু’জন বন্ধু ভারতের হকি ম্যাচ দেখত আর প্রত্যেকটা হারের পর আমার কাছে এসে রেগেমেগে বলত, তোমাদের অস্ট্রেলীয় কোচটা প্লেয়ারদের খাটিয়ে আধমরা করে রেখেছে। ওরা মাঠে নেমে ভাল খেলবে কী করে?
টেনিস শেষ হওয়ার পর লন্ডনে শেষ ক’দিন আমিও একটুআধটু খোঁজখবর নিয়েছি হকির বিপর্যয় নিয়ে। মনে হচ্ছে, আমার লন্ডনের বন্ধুরাই ঠিক। মাইকেল নবস এক বছর থেকে ছ’মাস আগেও আমাদের মনে যে স্বপ্ন তৈরি করেছিলেন, বলতে গেলে নিজের হাতেই সেই স্বপ্নকে ভেঙে টুকরো করে দিলেন। আজলান শাহের আগে পর্যন্ত যে ছেলেগুলোকে প্রচণ্ড ফিট, অ্যাস্ট্রোটার্ফে ভয়ঙ্কর দ্রুত দেখাচ্ছিল, অলিম্পিক যাওয়ার আগে মালয়েশিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকার টুর্নামেন্টে তাদেরই কেমন বেমানান লাগছিল। ম্যাচে যেন ধুঁকছে! বিদেশি কোচের শেখানো আধুনিক হকির সব ট্যাকটিক্সই প্রয়োগের চেষ্টা করছে, কিন্তু পঞ্চাশ ভাগও সফল হচ্ছে না। এ রকমটা তখনই হয়, যখন প্লেয়ারদের অত্যাধিক ও অপ্রয়োজনীয় প্র্যাক্টিস করানো হয়। |
প্রস্তুতিতেই শরীরের সমস্তটুকু নিংড়ে যাওয়ায় আসল ম্যাচে নেমে আর শরীর কিংবা মন কোনওটাই পুরোপুরি সাড়া দেয় না। স্কিল থাকলেও সেটা মাঠে দেখানোর শারীরিক অবস্থা থাকে না। সন্দীপ-সর্দার সিংহদের অলিম্পিকে চরম বিপর্যয়ের আমার মতে এটাই বড় কারণ। আর এক অস্ট্রেলীয় গ্রেগ চ্যাপেলের মতোই যেন কোচিং দর্শন নবসের। প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেট কোচের দশাই না হয় জাতীয় হকি কোচের ভারতে ফিরে।
অলিম্পিক হকিতে ভারতের সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্সের পর এমনও প্রশ্ন উঠছে যে, অ্যাস্ট্রোটার্ফে, আধুনিক নিয়মে কী ভাবে হকি খেলতে হয় সেটা ভারত আদৌ জানে কি? অতটা হেয় করা বোধহয় ঠিক নয়। বিশ্ব হকিতে ভারত এখনও বড় শক্তির মর্যাদা পায়। লন্ডনেও দেখেছি, অন্য যে খেলায় ভারতীয় অ্যাথলিটরা যে রকমই করুক না কেন, বেশির ভাগ বিদেশিই বেশি আগ্রহী ভারতীয় হকি দলের রেজাল্ট জানতে। সত্যি বলতে কী, দলগত খেলায় এখনও হকি ছাড়া ভারত আর কোনও খেলায় বিশ্বে প্রথম বারো দেশে নেই। ক্রিকেটের কথা বাদ দিচ্ছি। এখনও বিশ্বব্যাপী স্পোর্ট হয়ে ওঠেনি বলে।
’৭২-এর মিউনিখ অলিম্পিকে আমাদের টিম ব্রোঞ্জ জেতা সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছিল যেন হেরে দেশে ফিরছি। ৪০ বছর পর সেই আবেগ দেখানোর আভিজাত্য আমাদের হকির নেই। কিন্তু প্লেয়ারদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা নেইনবসের এই কথার সঙ্গে আদৌ একমত হতে পারছি না। চার বছরে একবারঅলিম্পিক-মঞ্চে প্রত্যেক অ্যাথলিট নিজের সেরাটা দিতে মুখিয়ে থাকে। আমাদের হকি প্লেয়ারদের টুর্নামেন্ট-ফিটনেস বলতে যেটা বোঝায়, সেই চাঙ্গা ভাবটা লন্ডনে না থাকায় বিপর্যয় ঘটেছে। প্রতিটা ম্যাচে ডিফেন্সে যেমন অজস্র ফাঁকফোকর বেরিয়েছে, তেমনই আক্রমণে ফিনিশিংয়ের অভাব ফুটে উঠেছে ক্লান্ত মস্তিষ্কের কোষগুলো মোক্ষম সময়ে ঠিক মতো সাড়া না দেওয়ায়। তবু আমি নবসকে আরও দু’তিন বছর রেখে দেওয়ার পক্ষে। নবস আমার মতে অনেকটা সেই ওষুধ, যেটা প্রথমে রোগের তীব্রতা একটু বাড়িয়ে দিয়ে তার পরে আমূল নিরাময় ঘটায়। নবস পরের অলিম্পিক পর্যন্ত সুযোগ পেলে আমার মনে হয় ভারতীয় হকির ভালই হবে। হাজার হোক, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দেশের কোচ। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি, ট্রেনিং, স্ট্র্যাটেজির ধারক। হকিতে তো এখন ফুটবলের মতো ‘অফ দ্য বল’-ও খেলতে হয়।
তা ছাড়া বিশ্ব হকির অর্থনীতি বিশ্ব ক্রিকেটের মতোই অনেকটা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। অলিম্পিক থেকে বিশ্বকাপস্টেডিয়ামের আশি ভাগ হোর্ডিংই ভারতীয় কোম্পানির। যে কারণে ভারতীয় হকি সংস্থার আভ্যন্তরীণ গণ্ডগোল থামাতে অথবা ওয়ার্ল্ড সিরিজ হকি ভারতে সফল করতে এফআইএইচ এত মরিয়া। তবে ওয়ার্ল্ড সিরিজ হকির মাধ্যমে ভারতীয় হকি আবার আলোয় ফিরতে পারে। বিদেশি কোচিং, শিল্পপতিদের বিশাল লগ্নি, অন্য দেশের শীর্ষ প্লেয়ারদের সঙ্গে খেলার সুযোগএ সব আইপিএলের মতোই আমাদের দেশের হকিতেও ‘বুম’ আনবে।
বারোর মধ্যে বারো হওয়াটা তাই ভারতীয় হকির মৃত্যুঘণ্টা নয়, আমার মতে অ্যালার্ম-ঘণ্টা।
|
লজ্জার খতিয়ান |
• এই প্রথম অলিম্পিকে ভারত সব ক’টা ম্যাচ হারল।
• ছ’টা ম্যাচে ২১ গোল হজম। করেছে মাত্র ৮ গোল।
• অলিম্পিকে ভারতের সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স। ১২ দেশের মধ্যে ১২। |
|
দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ১১-১২তম স্থান নির্ণায়ক ম্যাচেও ২-৩ হেরে ২০১২ অলিম্পিকে হকিতে ভারত সর্বশেষ স্থান পেল। ১২ দেশের মধ্যে ১২তম! আট বারের সোনাজয়ী ভারতীয় হকির অলিম্পিক ইতিহাসে বৃহত্তম বিপর্যয়। তীব্র হতাশ অধিনায়ক, শিলিগুড়ির গোলকিপার ভরত ছেত্রী বলেছেন, “আমরা অলিম্পিকে খেলার যোগ্যই নই। ছ’টা ম্যাচেই নইলে হারি না!” হকি ইন্ডিয়া কালক্ষেপ না করে এ দিনই এই চরম বিপর্যয়ের ময়নাতদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্দেশ দিয়েছে, তদন্ত কমিটি গড়ার। দশ দিনের মধ্যে দলের কোচ, ম্যানেজার, ফিজিও প্রত্যেককে আলাদা আলাদা রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। গ্রুপের পাঁচটি ও এ দিনেরটা নিয়ে ছ’টা ম্যাচেই ভারত হারল। অলিম্পিকে এই প্রথম একটিও পয়েন্ট পেল না। কোচ নবস বলেছেন, “মানসিক ভাবে এই ফল হজম করা কঠিন। এই বিপর্যয় এ দিনের ম্যাচের আগেই গোটা দলের মনের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। ফলে শেষ ম্যাচেও হারতে হল আমাদের।” অলিম্পিক হকিতে চ্যাম্পিয়ন হল জার্মানি। শনিবার নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারাল তারা। গ্রেট ব্রিটেনকে ৩-১ হারিয়ে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া ব্রোঞ্জ জিতেছে। আর কোরিয়াকে ৩-২ হারিয়ে পাকিস্তান সপ্তম। |