|
|
|
|
|
প্রবন্ধ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
বিবেক মানে কী?
তা কি কোনও বায়বীয় বস্তু?
|
|
বিবেক কি শুধু মঙ্গলচিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত? একেবারে বিবেকবর্জিত
কোনও মানুষ
টিকে
থাকতে পারে? এই শব্দটি নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা
করতে হবে। চিন্তার সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
সম্প্রতি গুয়াহাটিতে একটি অতি কুৎসিত ঘটনা ঘটেছে। তখন বেশি রাত নয়, মাত্র সাড়ে ন’টা, রাস্তায় লোকজনের চলাচল থামেনি, তারই মধ্যে একটি দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন অত্যাচার শুরু করে গুটিকয়েক পেঁচি মাতাল। পথচারীরা দাঁড়িয়ে পড়ে সেই দৃশ্য দেখে, আরও কয়েক লক্ষ মানুষ সেই বাস্তব দৃশ্যটি দেখতে পায় টিভি-র সম্প্রচারে, প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে। সাধারণত এ ধরনের ছবি প্রায়ই দেখা যায় ইদানীংকার অনেক সিনেমায়, বলাই বাহুল্য সে সব সাজানো। এ ঘটনা দেখানো হয়েছে, যাকে বলে ‘লাইভ’, অত্যাচারিত মেয়েটির মুখ স্পষ্ট, সে কোন স্কুলে পড়ে, তার নাম, এ সবও জানানো হয়েছে। কী করে তা সম্ভব হল? সেখানে দৈবাৎ উপস্থিত ছিলেন এক জন দক্ষ ফোটোগ্রাফার, তিনি ভিডিয়ো ক্যামেরায় পুরো দৃশ্যটি তুলে রাখেন, যাতে ওই সব নিপীড়নকারীর বাঁদরামি এবং মেয়েটির অসহায় কান্না আর বাঁচার চেষ্টা, সবই ফুটে ওঠে নিপুণ ভাবে। এক জন ফোটোগ্রাফারের পক্ষে এটা খুবই কৃতিত্বের ব্যাপার। নিউজ ফোটগ্রাফি হিসেবে খুবই বিরল দৃষ্টান্ত। তবু এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে হইচই শুরু হয়, ক্যামেরাম্যানটির পক্ষে আর বিপক্ষে শুরু হয় তর্কাতর্কি। ক্যামেরাম্যানটির বক্তব্য ছিল এই যে, এই ছবি থেকে অত্যাচারীদের মুখ চেনা অনেক সহজ হবে, তাদের শাস্তির পথও সুগম হবে। অন্য পক্ষের বক্তব্য, এক জন ক্যামেরাম্যান তো শুধুই ফোটো-জার্নালিস্ট নন, তিনি তো এক জন দায়িত্বশীল নাগরিকও বটে। ততক্ষণ ধরে ওই ছবি তোলায় ব্যস্ত না থেকে, তিনি কি মেয়েটিকে বাঁচাবার কিছু চেষ্টাও করতে পারতেন না? তিনি তো একা ছিলেন না, সেখানে অন্যান্য দর্শকও উপস্থিত ছিলেন!
এই উপলক্ষে আমার মনে পড়ল আর একটি ঘটনা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জাপানে। সে দেশের অর্থমন্ত্রী এক দিন তাঁর এক বান্ধবীকে নিয়ে লাঞ্চ খেতে এসেছিলেন এক নামকরা রেস্তোরাঁয়। সে সব দিনে পৃথিবীর কোনও দেশেই মন্ত্রী বা সরকারি ক্ষমতাবানদের জন্য এত নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাহুল্য ছিল না। তাঁরা অনেক স্বাধীন ভাবে রাস্তাঘাটে বেরুতে পারতেন। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নাইট শো-এ সিনেমা দেখার পর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন, এ দৃশ্যও তো আমরা দেখেছি! যাই হোক, সে দিন সেই রেস্তোরাঁয় অকস্মাৎ দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল খোলা তলোয়ার হাতে এক আততায়ী। সে সোজা দৌড়ে এসে অর্থমন্ত্রীর পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। সেই গমগমে আহারালয়ে অন্য সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল। অর্থমন্ত্রীর পাশের টেবিলেই বসে ছিলেন এক বিখ্যাত সংবাদপত্রের ফোটোগ্রাফার, তিনিও আততায়ীটি ঢোকার সময়ই দেখতে পেয়েছিলেন, ইনস্টিঙ্ক্ট-এর বশেই ক্যামেরা হাতে নিয়ে তিনি তুলে ফেললেন সেই হত্যাদৃশ্য। |
|
কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়? গুয়াহাটির সেই মর্মান্তিক ঘটনার এক মুহূর্ত। |
এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য দেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যমের শিরোমণিদের সুপারিশে সেই ফোটোগ্রাফারকে দেওয়া হয় বছরের শ্রেষ্ঠ ফোটো জার্নালিস্টের সম্মান। এবং আগামী দু’বছরের জন্য কোনও পত্র-পত্রিকায় তাঁর ছবি নিষিদ্ধ হয়ে যায়, এই শাস্তি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ছবি তোলার বদলে ফোটোগ্রাফারটি যদি তাঁর ক্যামেরাটি ছুড়ে দিতেন সেই আততায়ীর দিকে, তা হলেও হয়তো সেই অর্থমন্ত্রীর প্রাণ বাঁচানো যেত।
আর একটি ঘটনাও জেনেছিল পৃথিবীর সব দেশের মানুষ। প্রায় দু’দশক আগের কথা। সেটা আবার মনে করিয়ে দিলেন শ্রীমতী অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায় নামে এক সাংবাদিক। আমেরিকার বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার কেভিন কার্টার গিয়েছিলেন সুদান। এই দুর্ভাগা দেশটায় যে কত কাল ধরে দুর্ভিক্ষের মতন অবস্থা আর আত্ম-হানাহানি চলছে তার ঠিক নেই, প্রতি বছরই এর জন্য বহু মানুষ মরে।
মাঠের মধ্যে পড়ে আছে একটি কঙ্কালসার শিশু। অনাহারে, অবহেলায় সে প্রায় মুমূর্ষু। আকাশে উড়ছে অনেক শকুন। শকুনরা সাধারণত মৃত প্রাণীদের মাংস খায়, এই শকুনগুলো কি ছেলেটির মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে ধৈর্য ধরে, না কি নেমে আসবে আগেই? অদূরে একটা ঝোপের মধ্যে ক্যামেরা বাগিয়ে অপেক্ষা করছেন কেভিন কার্টার। অনেক সময় কোনও বিরল দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার জন্য ফোটোগ্রাফারদের অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকী দিনের পর দিন।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে আকাশ থেকে নেমে এল কয়েকটা শকুন, গুটি গুটি পায়ে তারা এগোল শিশুটির দিকে। সে তখনও বেঁচে আছে।
শকুনরা এক জীবন্ত শিশুর মাংস খুবলে খুবলে খাচ্ছে, এ রকম ছবি আগে কে দেখেছে? এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য কেভিন পান পুলিৎজার পুরস্কার। তবু বহু মানুষের প্রশ্নের বাণ বিদ্ধ করেছে তাঁকে। তিনি কি শুধুই এক জন ফোটোগ্রাফার? এক জন বিবেকসম্পন্ন মানুষ নন? ছবি তোলার বদলে ছেলেটিকে তুলে, কিছুটা স্নেহ, কিছুটা সেবা, কিছু খাদ্য ও ওষুধের ব্যবস্থা করলে সে হয়তো বেঁচে যেত। মানবিকতা সেটাই দাবি করে। সম্ভবত সেই সব প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত হয়েই কেভিন আত্মহত্যা করেন এক বছর পর।
এই পর্যন্ত লিখে হঠাৎ আমার মনেও একটা প্রশ্ন জাগল, এই রে, আমাদের এখানকার বহু সংবাদ-ফোটোগ্রাফার আছেন। কেউ যদি হঠাৎ আমার এই লেখাটি পড়ে ফেলেন, তা হলে কি মনে করবেন যে আমি ফোটোগ্রাফার প্রজাতিকে হেয় করার জন্যই এ সব লিখছি? তা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। এটা একেবারেই সত্যি। আমি যত জন সংবাদ-ফোটোগ্রাফারের কাজকর্ম দেখেছি কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, তাঁদের কারওর মধ্যেই মানবিকতার বিন্দুমাত্র অভাব দেখিনি। বরং বেশ কয়েক জনই কিছু কিছু সেবার কাজেও যুক্ত। আমাকে আসলে জ্বালাতন করছে ‘বিবেক’ শব্দটি।
বিবেক জিনিসটা ঠিক কী? ইংরাজিতে বলে, কনশ্যেন্স, সেটারও স্পষ্ট কোনও সংজ্ঞা নেই। মানুষে-মানুষে কি এই বিবেক বোধ আলাদা হতে পারে? আমরা যৌবনবেলায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের একটা লাইন আউড়ে বেশ আনন্দ পেতাম। ‘শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?’ বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি হয় যে, শরীরের বাস্তবতা বড্ড বেশি প্রকট, আর মন খানিকটা উড়ু-উড়ু ব্যাপার। সেই মন আর বিবেক বোধ কি এক হতে পারে? কিংবা বিবেক কি শুধু মঙ্গলচিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত? একেবারে বিবেকবর্জিত কোনও মানুষ টিকে থাকতে পারে? যে সব মানুষ বা রাজনৈতিক দলের নেতা ট্রেন লাইন উড়িয়ে দিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলতে চায়, তাদের কারও কি বিবেক নামে বায়বীয় বস্তুটির কোনও অস্তিত্ব থাকে না? এই শব্দটি নিয়ে আরও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
|
‘নুন চা’ এবং পাহাড় অঞ্চলে বাংলা |
‘নুন চা’ নামে বিমল লামা রচিত একটি ছোট উপন্যাস আমিও পড়েছি, আর সেই লেখকের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছি। লেখাটি আমায় খুবই আকৃষ্ট করেছে। নেপালি ভাষাতেও এ রকম কোনও গ্রন্থ রচিত হলে তা আমাদের গর্বের বিষয় হতে পারে। উপন্যাসটির ভাষা ও চরিত্রের রেখাচিত্রগুলির সংলাপ এমনই নিপুণ যে, আমার মনে এখনও একটু খটকা রয়ে গেছে, লেখক কি সত্যিই আমাদের পাহাড় অঞ্চলের নেপালি, না কি কোনও বাঙালি লেখকের ছদ্মনাম?
এ বিষয়ে আমার চেয়ে অনেক ভাল বুঝবেন দেবেশ রায়। তাঁর বসতবাটি ওই অঞ্চলেই এবং গোটা উত্তরবঙ্গ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা দীর্ঘ দিনের। তাঁর অনেক উপন্যাসে তা প্রতিফলিত হয়েছে। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত এখন ক্লাসিকের পর্যায়ভুক্ত। দেবেশ রায় আমার অনেক কালের পরিচিত এবং বন্ধু। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পরীক্ষাটা এক সঙ্গে দিয়েছিলাম। বলাই বাহুল্য যে, সেই পরীক্ষার ফলাফলে দেবেশের স্থান ছিল একেবারে শীর্ষস্থানে, আর আমি একেবারে নীচের সারিতে কোনও মতে ঝুলে ছিলাম। এর পর দেবেশ রায় কৃতিত্বের সঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন অনেক বছর, সাহিত্য রচনাতেও পেয়েছেন প্রভূত খ্যাতি, মাঝে মাঝে রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও তাঁকে ভূমিকা নিতে দেখা যায়। আমি এর কাছাকাছিও পৌঁছতে পারিনি। পাহাড় অঞ্চলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন বাংলা ভাষা শিক্ষার সুযোগ পায় কি না, সে সম্পর্কেও আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। দেবেশই তা ভাল জানবেন। আমি প্রত্যেক মানুষেরই নিজের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার ও প্রসারের চেষ্টা সমর্থন করি। এ রাজ্যে নেপালি, উর্দু বা সাঁওতালি ভাষার শিক্ষার সুযোগ থাকার পক্ষপাতী। কৈশোর বয়েসে দু’তিনটে ভাষা শিক্ষা মোটেই শক্ত কিছু নয়। সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা শুধু মহারাষ্ট্রের জন্যই নয়, প্রত্যেক রাজ্যের স্কুলে সেই রাজ্যের মূল ভাষার শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। আমি সেই নীতি পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োগের দাবি করি। দেবেশ রায়ও তা-ই চান জেনে খুব আনন্দ হল। |
|
|
|
|
|