বছর আড়াই আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে যখন টেলিফোনে প্রস্তাবটা এসেছিল, তখন বেশ অবাকই হয়েছিলেন কর্নেল ইউনিভার্সিটির বাঙালি অধ্যাপকটি। একেবারে অন্য রকম দায়িত্ব। তবু পূর্বপরিচিত মনমোহন সিংহের কথা ফেলতে পারেননি।
তিনি কৌশিক বসু। যাঁকে অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা করে দিল্লিতে নিয়ে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সে সময় অনেকেই বেশ অবাক হয়েছিলেন। কারণ তিনিই প্রথম ব্যক্তি, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার মতো পদে যোগ দেওয়ার আগে সরকারের অন্দরমহলে কাজ করার কোনও অভিজ্ঞতাই যাঁর ছিল না। তবে চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন কৌশিকবাবু।
প্রায় আড়াই বছর অর্থ মন্ত্রকে কাটানোর পরে আজ নিজের ‘কাজ’ থেকে অবসর নিলেন কৌশিক বসু। আজ শেষ দিনে কিছুটা আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েছিলেন বছর ষাটের মানুষটি। অর্থনীতিতে আবেগ থাকে না। কিন্তু সে তত্ত্ব সব সময় কাজ করে কি? অর্থনীতির তুখোড় ছাত্রটি যেমন মেনে নিচ্ছেন শেষ দিনে আবেগের কথা। |
নয়াদিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কৌশিক বসু। —নিজস্ব চিত্র |
বলছেন, “এখনও এতটা বুড়ো হয়ে যাইনি। তা-ও কিছুটা আবেগপ্রবণ তো লাগছে।”
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কোথায় সাফল্যের ছাপ রেখেছেন? অর্থ মন্ত্রকের কর্তাদের মতে, মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানার জন্য কৌশিকবাবুর নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রক গোষ্ঠী তৈরি করে দিয়েছিলেন মনমোহন। সেই গোষ্ঠীই খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খুলে দেওয়ার সুপারিশ করে এবং ডিজেলে ভর্তুকি তোলার কথা বলে। কৌশিকবাবু এক বার মজা করে বলেছিলেন, তাঁর বাড়ির পরিচারিকা মনে করেন যে তিনি জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর কাজ করেন! আবার তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ীই ব্রিকস গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির উন্নয়নের জন্য একটি ব্যাঙ্ক তৈরির কাজ শুরু হয়। এ ছাড়া আর্থিক সমীক্ষা তৈরির ক্ষেত্রেও নতুন দিশা দেখিয়েছেন সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রাক্তন ছাত্রটি।
কৌশিক বসুর বাবা ছিলেন কলকাতার প্রাক্তন মেয়র কেশবচন্দ্র বসু। সেন্ট জেভিয়ার্সের পরে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স। সেখান থেকে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকসে পিএইচডি করতে চলে যান তিনি। লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিকস ছাড়াও দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকস, প্রিন্সটন, হাভার্ড ও কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন। অর্থ মন্ত্রকে যখন যোগ দেন, তখন তাঁর জীবনপঞ্জী (সিভি)-র আয়তন ছিল ২৩ পৃষ্ঠা! বাঙালি অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাঙালি আর্থিক উপদেষ্টা। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?
কৌশিকবাবু জানাচ্ছেন, মনমোহন সিংহকে চিনলেও অর্থ মন্ত্রকে যোগ দেওয়ার আগে তিনি প্রণববাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন না। কিন্তু কাজের অভিজ্ঞতা যথেষ্টই মধুর। প্রণববাবু কখনওই তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করেননি। পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাঁর যে কোনও সুপারিশ, তা সে রূপায়ণ করা হোক বা না হোক, মন দিয়ে শুনতেন।
অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা মনে করেন, রাইসিনা হিলসে নর্থ ব্লকের অন্দরমহলে তিন বছর কাটালেও পুরোপুরি সরকারি আমলা হয়ে ওঠেননি কৌশিকবাবু। তিনি নিজেও মানেন সে কথা। অর্থ মন্ত্রকে যোগ দেওয়ার আগে মূলত পূর্ব পরিচয়ের সূত্রে প্রথম প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে ‘প্রফেসর সিংহ’ বলেই সম্বোধন করতেন। পরে সেই অভ্যাস পাল্টেছেন। তাঁর নানা মন্তব্য ঘিরে মাঝেমধ্যে বিতর্ক তৈরি হলেও বরাবরই মনের কথা খুলে বলেছেন বলে কৌশিকবাবুর দাবি। একবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো ছোটখাটো সরকারি পরিষেবা পেতে যাঁরা ঘুষ দেন, তাঁদের আইনত অপরাধী বলা যাবে না। আজ শেষ দিনেও জানিয়ে গেলেন, দুর্নীতি পুরোপুরি মুছে ফেলা যাবে না। তবে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সরকারের উপর অণ্ণা হজারের মতো নাগরিক সমাজের চাপ থাকা ভাল। কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আরেক দল আমলা নিয়োগ করলে কোনও লাভ হবে না। সেখানেও দুর্নীতি হবে।
শেষ দিনে নিজের মধ্যে কিছুটা আবেগ কাজ করলেও অর্থনীতিতে যে আবেগের কোনও স্থান নেই, উপদেষ্টা হিসেবে শেষ দিনেও তা মনে করিয়ে দিয়েছেন কৌশিকবাবু। ভারতীয় অর্থনীতির জন্য আশঙ্কার কথা শুনিয়ে অর্থ মন্ত্রকের সদ্য প্রাক্তন উপদেষ্টার ভবিষ্যদ্বাণী, চলতি অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬%-এর নীচেই থাকবে। মূল্যবৃদ্ধির হার সেপ্টেম্বর মাসে ৭%-এ নেমে এলেও তার পরে ফের খরা পরিস্থিতির জন্য মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে।
খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ বা ডিজেলে ভর্তুকি প্রত্যাহারের যে সুপারিশ তিনি করেছিলেন, তা এখনও কার্যকর হয়নি। তবে এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই তাঁর। কৌশিকবাবুর কথায়, “মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে আমি আমার সুপারিশ করেছি। কিন্তু সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খরার ফলে আবার দাম বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের কথা মাথায় রাখতে হবে। তাই ডিজেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সরকারকে সঠিক সময় বেছে নিতে হবে।” এ সব কারণে সংস্কারের গতিতে শ্লথতা এসেছে বলে মানলেও মোটেই হতাশ নন তিনি। দেশে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বা চড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং আর্থিক বৃদ্ধির নিচু হারের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও মানতে রাজি নন কৌশিকবাবু। |