সামান্য দাবি-দাওয়ায় শিক্ষক-ঘেরাও নতুন কিছু নয়। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাতে পড়ুয়া-নিগ্রহের অভিযোগও ওঠে প্রায়শয়ই। শিক্ষক-পড়ুয়া সম্পর্ক কতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এই সব ঘটনায় বারবার ওঠে সে প্রশ্নও। মঙ্গলবার মঙ্গলকোটের ইট্যা হাইস্কুলেও পড়ুয়াদের হাতে ঘেরাও হলেন এক শিক্ষক। তবে চিত্রটা সম্পূর্ণ আলাদা। বদলি নিয়ে অন্য স্কুলে যেতে উদ্যোগী ওই শিক্ষকের হাতে ধরে পড়ুয়াদের অনুরোধ, “আমাদের ছেড়ে যাবেন না।”
কিছু দিন আগে হুগলির চন্দননগরে খলিসানি কলেজে এক শিক্ষকের বদলি রুখতে কার্যত আন্দোলনে নেমেছিলেন পড়ুয়ারা। গত সপ্তাহেই উত্তর ২৪ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জে এক স্কুলে তাঁকে ঘিরে পড়ুয়াদের আবেগ দেখে শিক্ষক বলেছিলেন, “তোরা ক্লাসে চল। আমি অন্য স্কুলে যাব না।” আর এ দিন ইট্যা হাইস্কুলের পড়ুয়ারা তাঁর হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলার পরে ইংরেজির শিক্ষক দিব্যেন্দু পাল বললেন, “এই ভালবাসা কী ভাবে ফিরিয়ে দেব জানি না।” |
বর্ধমানের গাংপুরের বাসিন্দা দিব্যেন্দুবাবু ইট্যা হাইস্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ২০০৭-এ। প্রতি দিন তিন বার বাস পাল্টে স্কুলে পৌঁছতে হয় তাঁকে। বাড়ির কাছের স্কুলে বদলি করার জন্য গত ১৮ মার্চ তিনি ‘মিউচুয়াল ট্রান্সফার’-এর জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের কাছে আবেদন করেন। সোমবার সে সংক্রান্ত শুনানির জন্য চিঠি পান। এই খবর শুনে সে দিন বিকেলেই স্কুল পরিচাল সমিতির সদস্যেরা ও কিছু অভিভাবক দিব্যেন্দুবাবুকে স্কুল ছেড়ে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
মঙ্গলবার স্কুলে মৌখিক পরীক্ষা ছিল। দিব্যেন্দুবাবু স্কুলে পৌঁছতেই তাঁকে ঘিরে ধরেন পড়ুয়ারা। শুরু হয় কান্নাকাটি। একটি ক্লাসঘরে নিয়ে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে স্কুল না ছাড়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। দশম শ্রেণির ছাত্রী মৌসুমি সাহা, মোনালিসা মণ্ডলেরা বলে, “আমরা পঞ্চম শ্রেণি থেকে দিব্যেন্দুবাবুর কাছে পড়ছি। তিনি আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন। কোনও বিষয় নিয়ে বারবার প্রশ্ন করলেও বিরক্ত হন না। ধৈর্য ধরে সব কিছু বুঝিয়ে দেন।” মানসী সাহা, মামন সাহারা জানায়, ক্লাসের বাইরেও নানা বিষয়ে তাদের সাহায্য করেন দিব্যেন্দুবাবু।
অভিভাবক অনুপম মণ্ডল, রূপচাঁদ শেখেরা বলেন, “শুধু পড়াশোনা নয়, উনি নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। দুঃস্থ পড়ুয়াদের বইপত্রও কিনে দেন।” স্কুলের শিক্ষক সুব্রত দত্ত, ঊমাবল অধিকারীদের মতে, “এখনকার দিনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পড়ুয়াদের প্রতি দরদ না থাকলে এক জন শিক্ষককে ঘিরে এমন আবেগ হয় না। ওঁর সহকর্মী হিসেবে আমরা গর্বিত।” স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রী সপ্তমী বৈরাগ্য, শ্রাবণী রায়চৌধুরীদের কথায়, “এই রকম শিক্ষককে স্কুল থেকে ছাড়া উচিত নয়।” পরিচালন সমিতির সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সাহা বলেন, “আমরা ওঁকে স্কুল ছেড়ে যেতে বারণ করেছি। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। আশা করি, পড়ুয়াদের চোখের জল এ বার তাঁর মনোভাব পাল্টাতে বাধ্য করবে।” স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গৌতম নায়েক বলেন, “এত দূর থেকে যাতায়াত করলেও দিব্যেন্দুবাবু সচরাচর কামাই করেন না। পড়ুয়াদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুর মতো। আমরা জানতাম, পড়ুয়ারা তাঁকে যেতে দিতে চাইবে না।” পড়ুয়াদের কান্না দেখে এ দিন চোখে জল দিব্যেন্দুবাবুরও। তিনি জানান, এত দূরের স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত করতে অনেক সময় লাগে। বাড়ির কাছাকাছি স্কুল হলে তাঁর সমস্যা কমবে। তিনি বলেন, “পরিবারের সুবিধার জন্য আমার বদলি হওয়া জরুরি। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা যে ভাবে আবেদন করল, এর পরে আমাকে ভেবে দেখতে হবে।” |