চার বছর আগের সোনালি দিন ফিরে দেখা। নতুন সোনার খিদে নিয়ে
অভিনব অভিলাষ
চার বছর পর কি খানিক কড়া পড়েছে তাঁর হাতের আঙুলগুলোয়?
২০০৮-এর ১১ অগস্ট। মনে হয়, এই সেদিন! বেজিং অলিম্পিকের ইন্ডোর শ্যুটিং হল-এর একতলায় দাঁড়িয়ে তিনি। তাঁর হাতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একের পর এক হাত। যে হাতের লম্বা লম্বা শিল্পীসুলভ আঙুল মাত্র কিছুক্ষণ আগে ভারতকে অলিম্পিকের প্রথম ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা দিল।
দেশ থেকে আসা টেক্সট-মেসেজে বানভাসি। এক সহকর্মী এমনও লিখে পাঠালেন, অলিম্পিক কভারকারী অধম সাংবাদিকের সৌভাগ্যেই নাকি সোনাটা এল!
সেটা যথেষ্টই বাড়াবাড়ি। কিন্তু ব্যাপারটা তখনও ভাল বুঝে ওঠা হয়নি। একে তো কী একটা খটমট ইভেন্ট। ১০ মিটার এয়ার-রাইফেল। একটা হলঘরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পটাপট টার্গেটে মারা। অদ্ভুত একটা কেঠো টাইপের জ্যাকেট পরতে হয় রাইফেল ছোড়ার আগে। অত জড়সড় হয়ে যে কী করে অর্জুনের মতো মনঃসংযোগ করা যায়! কে জানে বাবা!
পুরো ব্যাপারটাই আমজনতার কাছে খুব ভজঘট। মানে মূলস্রোতের খেলাধুলোর সঙ্গে সম্পর্করহিত।
তখনও পর্যন্ত ভারতে রাইফেল-অলিম্পিকের সঙ্গে একটাই নাম যেত কর্নেল রাজ্যবর্ধন রাঠৌড়। ২০০৪-এর আথেন্স অলিম্পিকে রুপোজয়ী শ্যুটার। অলিভ পাতার মুকুট-পরা হ্যান্ডসাম ফৌজি অলিম্পিক মেডেলে ঠোঁট ছুঁইয়ে। চোখটা তেরছা করে ক্যামেরার লেন্সের দিকে। ঠোঁটে আলগা হাসি এই হল বেজিং অলিম্পিকে-যাওয়া ভারতীয়দের স্পোর্টস-লকারে তদবধি জাঁক করার মতো ছবি।
বেজিংয়ের সেই মুহূর্ত।
আধুনিক চৈনিক ময়দানবদের বানানো নতুন এবং তাক-লাগানো বেজিং এয়ারপোর্টে নামতে-নামতে যদিও মনে হচ্ছিল, ১৯৮০ সালেও ভারত হকিতে অলিম্পিক সোনা পেয়েছিল। ক্লাস সিক্সের ছাত্র আবাসিক ইস্কুলের অনুশাসন চুলোয় দিয়ে চিৎকার করে গেয়েছিল ‘জনগণমন’। নিন্দুকেরা বলছিল বটে যে, মস্কো অলিম্পিক গাদা দেশ বয়কট করেছিল। সেই জন্যই সোনাটা এল। কিন্তু সে সবে আর কে পাত্তা দেয়!
আঠাশ বছর পর সেই জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল আবার। সিলিং থেকে ঠিকরে-আসা আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছিল ধীরে ধীরে ফ্ল্যাগ-স্ট্যান্ডে ওপরে উঠতে-থাকা ভারতের জাতীয় পতাকার গায়ে। মাঝখানে সুপার-রিন সাদার উপর অশোকচক্র। উপরের গেরুয়া, নীচের সবুজ ঝলকাচ্ছিল ক্রমাগত। একে তো জাতীয় সঙ্গীত। তার সঙ্গে আবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বিশ্বজয়ের সাফল্য! অমন একটা মুহূর্ত যে ঠিক কী অনুভূতি বয়ে আনে, মাফ করবেন, লেখার মতো ভাষার তাগদ নেই।
মাত্র গুটিকয়েক দর্শক। তাদের ভিতরে তিরতিরে সেই কাঁপনটা চলতে চলতেই রিমলেস চশমা-পরা যুবকের গলায় ঝুলে পড়ল দেশের ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তিগত ইভেন্টে অলিম্পিক সোনা।
বেজিং তার পরের ক’দিনে আরও কিছু বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটিয়েছিল। বক্সিংয়ে বিজেন্দ্র সিংহ এবং কুস্তিতে সুশীল কুমারের ব্রোঞ্জ। সেই নিরিখে দেখতে গেলে দেশের ইতিহাসে ‘সফলতম’ অলিম্পিক অভিযান (কী লজ্জা! ১২১ কোটির দেশ। তিনটে মেডেল নিয়েই বলছে ‘সফলতম’)। বক্সিং বা কুস্তি এয়ার রাইফেলের চেয়ে আমজনতার কাছে অনেক বেশি পরিচিতও বটে। কিন্তু অভিনবর একক সোনাটার ওজনই আলাদা।
‘কনগ্র্যাচুলেশনস্’ বলে হাত মেলাতে গিয়েই মনে হয়েছিল, কী নরম আর লম্বা-লম্বা আঙুল রে বাবা! এ কি রাইফেল-শ্যুটার? না শিল্পী? এমন আঙুল তো ছবি-আঁকিয়েদের হয়! আর কী ভাবলেশহীন! কে বলবে, দেশের খেলাধুলোর ইতিহাসে এই সবে একটা সুপার-ঐতিহাসিক কাণ্ড ঘটিয়ে উঠলেন। ধীরেসুস্থে কথা বলেন। কোনও উচ্ছ্বাস-টুচ্ছ্বাস নেই। বড্ড ‘ফোকাস্ড’। পরে জানা গেল, অলিম্পিকের জন্য তাঁর ব্রেন-ম্যাপিং হয়েছিল। কিন্তু তা হলেও কি মানুষ এতটাই নিরাবেগ আর নিরাসক্ত থাকতে পারে? হয়তো পারে। নইলে লন্ডন অলিম্পিকের আগে কেন বলবেন, “আমি খুশি যে দেশের সেরা অ্যাথলিটরা ট্রেনিংয়ের জন্য এখন অনেক বেশি সুযোগসুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু এখনও নিচুতলায় অবস্থাটা খুব হোপলেস। যে সব বাচ্চা এই জগতে ভালবেসে আসছে, তাদের জন্য আরও ভাল পরিকাঠামো, সুযোগসুবিধে এবং কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। ছোটবেলাটাই চ্যাম্পিয়ন তৈরির আসল সময়। কিন্তু সেটাকেই আমরা কোনও গুরুত্ব দিই না।”
আইআইটি-র ফার্স্ট বয়ের মতো দেখতে যুবক নিশ্চয়ই আরও জানেন, যেটুকু হচ্ছে, তা-ও তাঁর সোনাটার জন্যই। অলিম্পিক কভারেজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, ওই সোনাটা পাওয়ার আগে আশপাশটা বড্ড হ্যাক-ছি করত অলিম্পিক? সেখানে আবার ভারত কী করবে!
অভিনবর সোনা সেটা এক ঝটকায় মুছে দিতে পেরেছিল। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে লন্ডনে অদ্যাবধি বৃহত্তম দল পাঠিয়েছে ভারত মোট ১৩টা ইভেন্টে অ্যাথলিট এবং কোচ ইত্যাদি মিলিয়ে মোট ১৪২ জন (তার মধ্যে সানিয়া মির্জার মায়ের মতো কিছু ট্যুরিস্টও আছেন। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে অমন একটু-আধটু পোষণ হয়ে থাকে। আমরাও চোখ বুজে থাকি। বা খুলে। কারণ এত দিনে এসব গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে)। বলা হচ্ছে, বেশ কিছু পদকজয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। ‘অভিনব-সাফল্যে’র (সেটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। যে উদ্যোগে অভিনব বেজিং-পূর্ব সময়ে কোচিং নিতে গিয়েছিলেন জার্মানিতে। লন্ডন অলিম্পিক শুরুর আগেও হইহল্লায় বিরক্ত অভিনব গেম্স ভিলেজ থেকে চলে গিয়েছিলেন যেখানে) পর ২০০৯ সালে স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়াকে (সাই) ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রক। যা ভারতের খেলাধুলোর ইতিহাসে নজিরবিহীন। ২০১২ অলিম্পিকের জন্য ২০১১ সালের এপ্রিলে বরাদ্দ করা হয়েছিল ২৫৮ কোটি। যা খরচ করা হয়েছে গত একবছরে।
তাতেও অবশ্য সুশীল কুমারকে ব্যক্তিগত খরচে লন্ডনে ফিজিও নিয়ে যেতে হয়েছে। হরিয়ানার সোনেপতে সাইয়ের আখড়ায় ঘাম ঝরানোর পর খাবারের ব্যবস্থাটাও নিজেকেই করতে হয়েছে। কারণ সেখানে যে খাদ্য সরবরাহ করা হয়, তার মান, সুশীলের মতে, অলিম্পিক পদক আনার মতো নয়। কুস্তিগির, ম্যারাথন-দৌড়বাজ বা ভারোত্তোলক আপনি যা-ই হোন, পথ্য সেই ডাল-রুটি-পনির!
আমরা অবশ্য এসব মনে রাখতে চাই না। আমাদের এখন বড্ড মেডেল-খিদে পেয়েছে। যদিও এই জাবর কাটতে-কাটতেই শনিবার তিরন্দাজিতে পুরুষদের দলগত ইভেন্ট থেকে ছিটকে গিয়েছে ভারত! সামনে কী আছে, কে জানে!
তবু আমরা মনে রাখতে চাই বেজিংয়ে তাবৎ ভারতীয়ের রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া। অলিম্পিকের এক সেন্টার থেকে অন্য সেন্টারে যাওয়ার বাসে বিদেশিদের সম্ভ্রমভরা চাহনি। আচম্বিতে মহার্ঘ গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্রে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা। লন্ডন অলিম্পিক যখন গড়াতে শুরু করেছে, তখন হাজার হাজার মাইল দূরে বসে এক ভারতীয়ের অলিম্পিক সোনার জন্য পেটুক-চোখ রি-ওয়াইন্ড করছে বেজিংয়ের এক আপাত-অখ্যাত শ্যুটিং রেঞ্জের ভিকট্রি স্ট্যান্ডে সাদা জ্যাকেট আর হাঁটু-ঝুল ক্যাপ্রির চেহারা। গলায় ঝুলছে জেড পাথর আর সোনার মিশেল-দেওয়া ভুবনজয়ের অভিজ্ঞান। শিল্পীসুলভ আঙুলের মুঠিতে ফুলের তোড়া। দেখছে বিশাল হলঘরে গুটিকয় ভারতীয় সাংবাদিকের পরস্পরকে জড়িয়ে-ধরা। আকাশে কিছু মুষ্টিবদ্ধ হাতের বিশ্বজয়ী ঝাঁকুনিতে বাঙালি-অহমিয়া-ওড়িয়া-জাঠ-পঞ্জাবি-তামিল-তেলেগু-মরাঠি আত্মারা আত্মহারা। দেখছে ফ্ল্যাগ-স্ট্যান্ডে ধীরে ধীরে সকলকে ছাপিয়ে উঠে যাচ্ছে তার দেশের জাতীয় পতাকা। অনুভব করছে অন্তরে এখনও অমলিন শিহরনটুকু।
সিলিং থেকে আসা তীব্র আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে তেরঙা।
সোনালি অলিম্পিক-আভায় ভরে যাচ্ছে চরাচর।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.