গাড়িতে ছিপ, জাল আর মাছের চার
ই সেই আরিতার লেক?
সকালবেলায় রিসর্টের বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই এলোমেলো ভিজে হাওয়া। সামনে প্রায় এক কিমি লম্বা স্বচ্ছ জলের হ্রদ। ভেসে বেড়াচ্ছে গোটা দশেক রাজহাঁস।
গত রাতে এই হাঁসগুলিই তাদের কর্কশ যৌথসঙ্গীতে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। আরিতার পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার নেমে এসেছিল, সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি। ভিজে অন্ধকারে হ্রদ-টদ কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, টর্চের আলোয় পিচ্ছিল পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে কোনও ক্রমে রিসর্টে পৌঁছানো গিয়েছিল।
আর, এই ভোরে মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম! কারও কথা না শুনে সটান চলে এসেছিলাম সিকিমের এই পাহাড়ি হ্রদের ধারে। বৃষ্টিহীন কলকাতার বাইরে তিন দিনের জন্যও পাহাড়ি বৃষ্টির স্বাদ নেওয়া যাবে, সবুজ ঘাস আর গাছগাছালিতে চোখ জুড়োবে। ওই তো, সামনের গাছটায় ছোট্ট এক পাখি সুরেলা স্বরে তখন থেকে ডেকে চলেছে।
বৃষ্টি, পাখি, হ্রদ আর সবুজ পাহাড় দেখার জন্য আরিতারে আসাটা তাই দরকার ছিল।
আরিতার গ্যাংটক, পেলিং, রাবংলার মতো পরিচিত জায়গা নয়। পূর্ব সিকিমে ‘লামপোখরি’ নামে হ্রদকে কেন্দ্র করে ছোট্ট এক অচেনা জনপদ। গ্যাংটক, দার্জিলিঙে বৃষ্টি না পাওয়া গেলেও আরিতারে বৃষ্টি পাওয়া যাবেই। জায়গাটাকে অনেকে ‘সিকিমের চেরাপুঞ্জি’ বলে থাকেন।
শিলিগুড়ি, সেবক ছাড়িয়ে গাড়ি চড়াই বেয়ে যত উঠছে, মন ততই প্রফুল্ল। শুকনো থাকলে ঘন্টা পাঁচেক লাগে আরিতার, বৃষ্টি হলে খানিকটা বেশি। রাস্তার পাশে পাহাড়ের খাঁজে মেঘ আটকে আছে, তিস্তার স্রোতে এই দুপুরেও কাঁপা কাঁপা কুয়াশা। না, কুয়াশা নয়! টিপটিপ বৃষ্টি, আকাশের মেঘ এসে ঢলে পড়ছে তিস্তার কুমারী শরীরে। জল আর মেঘের এই আশ্লেষ অন্য সময় দেখা যায় না।
বৃষ্টির মধ্যেই সেবক পেরিয়ে গাড়ি বাঁক নিল কালিম্পং-এর রাস্তায়। বিকেল নেমে এসেছে, হেডলাইটের আলোয় ত্যারছাভাবে নেমে আসছে বৃষ্টির ফোঁটা। কালিম্পং পেরিয়ে লাভার একটু আগে বেঁকে গিয়েছে পথ। সিলারি, ঋষিখোলা’র মতো ছোট্ট গ্রাম পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে আরিতার।
এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা নেই। নেই আলোঝলমল দোকানপাট। আছে শুধু লামপোখরি হ্রদ। স্থানীয়দের কাছে পবিত্র, ফলে কেউ স্নান করেন না। মানত থাকলে অনেকে হ্রদের জলে রাজহাঁস ছেড়ে দিয়ে যান। সকালে সেই হাঁসগুলিকেই দেখছিলাম। হ্রদের ধারে টাঙানো পাতলা কাপড়ের প্রেয়ার ফ্ল্যাগগুলি ততক্ষণে গত রাতের বৃষ্টিতে ভিজে পতপতে হয়ে গেছে। রোদ উঠতেই সেগুলি ফের শুকিয়ে দুলে উঠছে হাওয়ায়।
হ্রদের উল্টো দিকে ‘মণিপদ্মে হুম্’ লেখা পাথরের ওপর ছোট্ট গোম্ফা। পুজোআচ্চা, বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে শহর থেকে কোনও লামা আসেন, কিন্তু সেটি ব্যতিক্রম। কোনও লামা নেই, পাথরের ওপর তৈরি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখলাম, পদ্মসম্ভবের মূর্তি। নীচে ধূপ জ্বলছে। একটু আগে গ্রামের মেয়েরা এসে ধূপ জ্বালিয়ে গিয়েছেন। সিকিমে রুমটেক, পেমিয়াংচি প্রমুখ ঐতিহ্যঋদ্ধ গোম্ফা অনেক আছে, কিন্তু পাথরের ওপর এই নামহীন ছোট্ট চৈত্য চমৎকার! দেখলাম নীচে গ্রামের কেউ ছোট্ট পাথরের শিবলিঙ্গ রেখে তার সামনে ছোট দুটি জলের গ্লাসও রেখে গিয়েছে। বৌদ্ধ পদ্মসম্ভব, হিন্দু শিব, সকলেই এখানে মিলেমিশে অবস্থান করেন।
চার দিকে জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হ্রদ, পায়ের নীচে বাঁধানো রাস্তা। অদূরের জিপরাস্তা এখান থেকে সোজা বেরিয়ে গিয়েছে জুলুক। চিন সীমান্তের লাগোয়া সাত হাজার ফুট উঁচু জুলুক এবং মেমেঞ্চু হ্রদ এত দিন পর্যটকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। গোটাটাই সেনা-এলাকা। এখন নাকি জুলুকে থাকার জন্য কয়েকটি ‘হোম-স্টে’ হয়ে গিয়েছে। আরিতার থেকে গাড়ি নিয়ে জুলুক থেকে ছাঙ্গু হয়ে সটান গ্যাংটক বেরিয়ে যাওয়া যায়।
সামনের পাহাড় বেয়ে উঠে গেলে ‘লাভদাঁড়া’ নামে একটি পিকনিক স্পট আছে। কিন্তু বর্ষায় জোঁকের রাজত্ব! বিকেলে বৃষ্টি থামলে তাই গ্রামে ঘুরতে বেরোলাম। ছোট ছোট দোকান, কিছুটা এগিয়ে ১৮৯৫ সালে তৈরি এক ডাকবাংলো।
পরের দিন গাড়িতে চেপে বসা গেল। গাড়িতে কয়েকটি ছিপ, নাইলনের ছোট খেপলা জাল এবং মাছের চার। সঙ্গে পিকনিকের উপযোগী চা, বিস্কুট, কেক, কলা এবং অনেক কিছু। কয়েক কিমি দূরের রংলিখোলায় চমৎকার ট্রাউট রয়েছে।
কিন্তু বর্ষায় ধস পড়ে সেই রাস্তা বন্ধ। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে যাওয়া গেল ঋষিখোলা। নেপালি ভাষায় খোলা মানে ছোট্ট পাহাড়ি নদী। নদীর বুকে ছড়ানো বোল্ডার, তারই মধ্যে তিরতির করে বয়ে চলেছে ঠান্ডা, স্বচ্ছ জল। ঋষিখোলার স্থানীয় এবং শৌখিন মৎস্যশিকারীদের সৌজন্যে জোগাড় করা হল একটি পোর্টেব্ল জেনারেটর সেট। জেনারেটর চলছে, তার সঙ্গে লম্বা তারে বাঁধা দুটি বাঁশের লাঠি। লাঠির শেষ প্রান্ত ইস্পাতের, ক্রিকেটের স্টাম্প যেমন দেখতে হয় আর কি! একটায় পজিটিভ কারেন্ট, অন্যটায় নেগেটিভ। এ বার লাঠি দুটি জলে ডুবিয়ে দিলেই কাছাকাছি থাকা মাছেরা ‘শক’ খেয়ে কিঞ্চিৎ নির্জীব ও অবসন্ন হয়ে পড়বে। তখনই দ্রুত জাল ফেলে, ছিপে গেঁথে সেগুলি তুলে নিতে হবে। দেরি হলে ঘোর কেটে যাবে, মাছগুলি সাঁতার কেটে চকিতে অন্যত্র বেরিয়ে যাবে। জানি, পরিবেশপ্রেমী লোকেরা এই কাহিনিতে রেগে যাবেন। কিন্তু জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ‘পলিটিকালি কারেক্ট’ হয়ে বাঁচা যায়?
ছোট বাটা মাছের সাইজের অনেক মাছ ধরা গেল। পাহাড়ি কাতলা। রাতে বনফায়ারের সময় হুইস্কি সহযোগে ওই মাছভাজা চমৎকার লাগছিল। হে পাহাড়ি মৎস্যকুল, তোমরা জানো না, ‘নায়ং হন্তি ন হন্যতে’। আত্মা হত হন না, তিনি কাউকে হত্যাও করেন না।
গীতাতত্ত্ব উপলব্ধি করার জন্যই এ বার আমার আরিতারে যাওয়া দরকার ছিল।

ছবি: প্রশান্ত মল্লিক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.