|
|
|
|
স্মরণ ৩... |
রাজেশকে সরাতে আমরা
অমিতাভকে তোল্লাই দিইনি
মুম্বই থেকে কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে তাঁর যত্নের ফার্মহাউস
পানভেল।
সেখানে বসে
উত্তেজিত সেলিম খান এক্সক্লুসিভ
সাক্ষাৎকার দিলেন গৌতম ভট্টাচার্য-কে |
|
|
মৃত্যুপরবর্তী রাজেশ খন্নাকে নিয়ে মিডিয়ার আদিখ্যেতা দেখে আমার বেশ মজাই লাগছে। ভুল বললাম, অসহ্য লাগছে! একেক সময় জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, দরদি বন্ধুরা আপনারা গত দশ বছর কোথায় ছিলেন?
গত পনেরো বছরের মধ্যে বছর দশেক আমি রাজেশের প্রতিবেশী ছিলাম। বান্দ্রাতে আমরা খুব কাছাকাছিই থাকতাম। তার পর এই গ্যালাক্সি অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসি। পুরনো পাড়ায় থাকার সময় কার্যত বেকার সেই রাজেশের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। মিডিয়ার কাউকে ওর ছায়াও মাড়াতে দেখিনি।
এখন অবশ্য রাজেশ লোভনীয় ব্যবসা। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাছে। রাজেশ মানে তার অমর সব ছবি। আর অসাধারণ সব গান। দুটো মিলে এমন লোভনীয় মেটেরিয়াল যে স্বচ্ছন্দে সাতদিন চলে যাবে। আর চলছেও। রাজেশ এখন এমনই ভরা বাজার যে দোকানে মাল হু হু বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আমার কথা হল রাজেশকে মন থেকে ভালবেসে এই প্রচারটা দেওয়া হলে এত দিন ওকে উপেক্ষা করা হল কেন? আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওবি ভ্যানগুলোর ভিড় শুরু হল যবে থেকে হাসপাতালে ও গুরুতর সংকটে। ভাবখানা এমন যেন কেউ কেউ বা অনেকে ওয়েট করেই ছিল যে কবে রাজেশ মারা যাবে আর ওকে ব্রেকিং নিউজ করে দেওয়া যাবে।
রাজেশের সঙ্গে আমরা দুটো ছবিতে কাজ করেছি। ‘আন্দাজ’ আর ‘হাতি মেরে সাথী’। দুটোই সুপারহিট। ‘হাতি মেরে সাথী’টা তো রাজেশের জীবনের সবচেয়ে বড় হিট। অথচ এই ছবির পরে আমরা আর কখনও ওর জন্য সংলাপ লিখিনি। রাজেশ খন্না আমাদের সঙ্গে কাজ করার আগেই এমন সুপারস্টার যে ওর আমাদের দরকার হয়নি। বিনীত ভাবে বলি সেলিম-জাভেদেরও দরকার হয়নি রাজেশ খন্নাকে।
রাজেশ মারা যাওয়ার পর সে দিন এক সাংবাদিক আমায় বলছিলেন, আপনারা রাজেশকে আরও বড় স্টার বানিয়ে দিলেন। আবার আপনারাই কি না ওঁর থেকে সরে গেলেন। আপনারাই রাজেশের সঙ্গে সম্পর্কহানির জবাব দিলেন অমিতাভকে তৈরি করে। মিডিয়ার এই বন্ধু নিশ্চিত যে ১৯৭৩ সালে রিলিজ করা ‘জঞ্জীর’ ডিজাইনই করা হয়েছিল রাজেশ বধ করে নতুন তারকা তৈরির জন্য।
এগুলো শুনে এত বিরক্ত লাগে কী বলব! লোকে যে কত ভুলভাল ধারণা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রথমত, কেউ কাউকে তৈরি করতে পারে না। তারকা সৃষ্টি হয় তার নিজের দক্ষতায়। সময়ের মেকানিজমে। অমিতাভ বচ্চনকে তৈরির কৃতিত্ব তাই মোটেও আমাদের নয়। বরঞ্চ আমি বলব ‘জঞ্জীর’ শুরু হওয়ার স্ক্রিপ্ট নিয়ে আমরা যে সব নায়কের দোরে দোরে ঘুরেছি আর প্রত্যাখ্যাত হয়েছি তারাই নতুন নায়ককে তৈরি করে দিয়েছিল।
ছবিটা সুপারহিট হওয়ার পরে নিশ্চয়ই ওদের মনে হয়েছিল ভুল সিদ্ধান্তে খাল কেটে কেমন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী এনে ফেলল! আমরা প্রথমে গিয়েছিলাম দিলীপকুমারের কাছে। দিলীপসাহেব না বললেন। গেলাম ধর্মেন্দ্রর কাছে। আবার না। এর পর দেব আনন্দ। সব শেষে রাজকুমার। স্ক্রিপ্ট শুনিয়ে একজনকেও সন্তুষ্ট করতে পারিনি। কেউ বলল গল্পটা ভীষণ ড্রাই। জমবে না। কেউ বলল বাজার খাবে না। ফরমুলার বাইরে। কেউ বলল দূর রোমান্স নেই। গান নেই। কমেডির অভাবের কথাও কেউ কেউ তুলল। তখন হিন্দি সিনেমায় কমেডি রীতিমতো বক্স অফিস ছিল। জনি ওয়াকার, মেহমুদ এঁরা একেকজন একেকটা ছবি টেনে দিতে পারতেন। এখানে কমেডি করারও সুযোগ নেই।
হতাশ হয়ে আমরা বুঝলাম এই স্ক্রিপ্ট নিয়ে কোনও নামী তারকাকে রাজি করানো যাবে না। রাজেশকে পড়ে শোনানোর সাহসই হয়নি। রাজেশের তখনকার যে রোমান্টিক ইমেজ তার সঙ্গে ‘জঞ্জীর’ যেত না। গান রাজেশের ছবির একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এখানে সেটারও সুযোগ নেই। আমরা তখন ঠিক করি স্টার নয় অথচ ভাল অভিনেতা এমন কাউকে নেব। তখনই অমিতাভ বচ্চনের কথা ভাবা হয়। কে জানত স্টার না হওয়া সেই ছেলেটাই ভবিষ্যতের ভারতবর্ষের সর্বকালের সেরা স্টার হয়ে দাঁড়াবে। |
|
‘আনন্দ’-য়ে অমিতাভের সঙ্গে |
নায়িকা খোঁজা নিয়ে আরেকটা সমস্যা ছিল ‘জঞ্জীর’এর। পুরো হিরোর ওপর গল্প। একে হিরোইনের কোনও রোল নেই তাও আবার এমন নায়ক যার কোনও বক্স অফিস নেই। যে নিছকই ভাল অভিনেতা। আমরা জানতাম যাকে অফার করা হবে সেই রিফিউজ করবে। তখন স্ট্র্যাটেজি ঠিক হয় যে জয়া ভাদুড়ি যখন এর সঙ্গে প্রেম করছে তখন ও নিশ্চয়ই রাজি হয়ে যাবে। হলও তাই। ঘটনাটা বললাম বোঝাতে যে কোন উচ্চতায় সূর্যের মতো ঝলমলে ছিল রাজেশ। আর কেমন দীনহীন ভাবে শুরু করতে হয়েছিল তারকা অমিতাভকে।
অমিতাভের ১৫টা ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছি আমরা। ‘জঞ্জীর’, ‘মজবুর’, ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’, ‘ডন’, ‘ত্রিশূল’, ‘শক্তি’...। একই সংলাপ লিখিয়ে আর একই নায়ক এতগুলো ছবিত— এটা সম্ভবত রেকর্ড। কিন্তু তার একটা কারণ ছিল। আমাদের কাছে অমিতাভের গুরুত্বটা থেকে গিয়েছিল। অমিতাভেরও নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল ওর কাছে সেলিম জাভেদের প্রয়োজন আছে। রাজেশের সঙ্গে সেই লম্বা পার্টনারশিপ তৈরির সুযোগই হয়নি। ও আর আমাদের সম্পর্কে আগ্রহ দেখাল কোথায়?
কী ছিল রাজেশের মধ্যে যে আসমুদ্রহিমাচল ওকে নিয়ে এমন উত্তাল ছিল। ১৯৬৯-’৭৫ এই সময়ের মধ্যে রাজেশের যে জনপ্রিয়তা ছিল তা ভারতবর্ষে আর কেউ কখনও চোখে দেখেনি। দিলীপকুমার থেকে শুর করে অমিতাভ, আমার ছেলে সলমন থেকে শুরু করে শাহরুখ, আমির কেউ দেখেনি। আর দেখবে বলেও মনে হয় না। রাজেশের অভিনয় কোথাও যেন কিছুটা দিলীপকুমার। কিছুটা রাজ কপূর। কিছুটা দেব আনন্দ। সূক্ষ্ম ভাবে সব কিছুর ছায়া মেশানো থাকত। এর সঙ্গে যোগ করেছিল নিজস্বতা। মিলে কম্বিনেশনটা এমন হয়ে যায় যে মার মার কাট কাট। রাজেশের সেরা সময়ে সংলাপ লিখতে বসে রীতিমতো অসহায় লাগত। মনে হত এক জন বাদে ইন্ডাস্ট্রিতে আর কোনও হিরোই নেই। এ যেন এক ঘোড়ার দৌড়। আসলে অনেকেই ছিল কিন্তু এমনই রাজেশের ক্যারিশমা যে ও যদি একশো হয় বাকিদের এমনকী দেব আনন্দ, ধর্মেন্দ্রদেরও মনে হত পঞ্চাশ।
ওর চূড়ান্ত সাফল্যের নিখুঁত বিশ্লেষণ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনও বিজ্ঞানী পারবে না। কোনও কেমিস্ট পারবে না। কোনও মনোবিজ্ঞানী পারবে না। গবেষণাগারে যে স্টারডম কাঁটাছেড়া করা যায় না। যদি যেত তা হলে সবাই সেটা করত। কেউ কি আজ অবধি বলতে পেরেছে উত্তমকুমারের ক্যারিশমাটা ঠিক কোথায়? কেন দিলীপকুমার সব সময়ই আলাদা? এগুলো ব্যাখ্যা করা যায় না।
রাজেশের সময়টা এসে কেন এত দ্রুত চলে গেল তারও নিখুঁত ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। ওর নাকি কাজে মন ছিল না। সাফল্যে মাথা ঘুরে গেছিল। সব সময় চামচে নিয়ে ঘুরত। আমার মতে প্রত্যেকটাই বোগাস কারণ। মার্লন ব্র্যান্ডোর একটা কথা আছে ‘‘অ্যাকটিং ইজ দ্য ইজিয়েস্ট জব ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ইফ ইউ আর সাকসেসফুল।” ব্যর্থতা হলেই কাজটা কঠিন লাগে। আমার কখনও মনে হয়নি রাজেশের কাজ থেকে মন চলে গেছে। আর সাফল্যে একটু আধটু প্রভাবিত হওয়া আর চামচা নিয়ে ঘোরা কে করে না আমায় বলুন তো। শতকরা একশো ভাগ করে। চামচেরা ভাল ভাল কথা বলে ইগোয় মালিশ দেয় আর যে কাছে থেকেও মনে করে অপ্রিয় সত্যি কথাটা বলবে, স্টার তাকে নির্দয় ভাবে সরিয়ে দেয়।
আমি জ্যোতিষচর্চায় প্রবল বিশ্বাসী। সময়ে বিশ্বাস করি। আমার মতে রাজেশের সাফল্য এসেছিল অদৃষ্টের আপন নিয়মে। আবার চলেও যায় সেই আপন নিয়মে। স্টারডম-এর রিয়েল সময়টা মাত্র পাঁচ-ছ’ বছরে আটকে থাকল কারণ ওর ভাগ্যে ওটাই ছিল। সময় চলে যাওয়ার পরে আর সময়কে ফেরত পাওয়া যায় না। তবে সময় থাকাকালীন বুদ্ধি বিবেচনা দেখালে সাফল্যের ওপর একটা পালিশ থেকে যায়। রাজেশ সেই বিবেচনা দেখায়নি।
আমি শুধু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি দেখেই সময়ে বিশ্বাসী এমন নয়। অন্য পেশাতেও একই জিনিস দেখেছি। ছোটবেলা ইনদওরে কেটেছে বলে মুস্তাক আলিকে ভাল চিনতাম। উনি একবার আমায় বলেছিলেন, সেলিম, সময় ভাল গেলে একটা মিস হিটও বাউন্ডারি হয়ে যায়। আর সময় খারাপ গেলে তুমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আউট হওয়ার নানান রাস্তা ঠিক খুঁজে পেয়ে যাবে। দিনের শেষে তুমি সময়ের দাস।
রাজেশও তাই ছিল। ভারতীয় সিনেমা জগৎ ওকে মনে রাখবে একটা ছোট সময়ের মধ্যে সেই সময়ের সর্বকালের সেরা প্রভাবশালী স্টার হিসেবে। আর আমি মিস করব এক বন্ধুকে যার সঙ্গে জীবন-যৌবন-স্টারডম-দর্শন অনেক কিছু নিয়ে গভীর আড্ডা মারা যেত... |
|
|
|
|
|