স্মরণ ২... |
অজানা উত্তর |
ধূমকেতুর মতো উত্থান। ধূমকেতুর মতোই পতন। তার মাঝখানে ছিল অনেক আলো-আঁধারি, অনেক কুয়াশা।
রাজেশ খন্না সম্বন্ধে সেই সব প্রশ্নের কখনও না পাওয়া জবাব খুঁজে পেলেন ইন্দ্রনীল রায় |
|
অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে সম্পর্ক কতটা খারাপ ছিল? |
‘আনন্দ’-এর সময় থেকেই ঘরোয়া আলোচনায় অমিতাভ বচ্চনকে ‘হ্যাঙ্গার সে লটকতা হিরো’ বলে সম্বোধন করতেন রাজেশ। দু’জনের সঙ্গে সমান বন্ধুত্বএমন কয়েকজন জানাচ্ছেন যে অমিতাভও জানতেন কাকাজি তাঁকে এই নামে সম্বোধন করেন। রাজেশের মৃত্যুর এক ঘণ্টার মধ্যে সেই অমিতাভ ‘আশীর্বাদ’ পৌঁছে গেছেন দেখে, সেই বন্ধুরাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের কথায়, এটাই অমিতাভ বচ্চনের মাহাত্ম্য। সত্যি বলতে, রাজেশ কেবল অমিতাভকে ওই নামে ডাকতেনই না, সেটে অপমানও করেছিলেন একবার। “তখন ‘বাবুর্চি’-র শ্যুটিং চলছে। জয়া তখন অমিতাভের সঙ্গে প্রেম করছেন। অমিতাভ ‘বাবুর্চি’-র সেটে এসেছিলেন জয়ার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে অমিতাভকে দেখে, রাজেশ খন্না অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিয়েছিলেন জয়াকে এমন ‘ফ্লপ হিরো’র সঙ্গে প্রেম করার জন্য,” বলছিলেন সাংবাদিক অজয় ব্রহ্মতমাজ। “যে বিশেষণটা ব্যবহার করেছিলেন, সেটা হল, ‘কিঁউ অমিত জ্যায়সে আটন-বটন হিরো কে সাথ মহব্বত করতি হো?”’ বলছিলেন অজয়। তারপর আর কোনও দিন দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়নি।
|
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বা শক্তি সামন্তের মতো বিশিষ্ট পরিচালকরা ছেড়ে চলে গেলেন কেন? |
সবার প্রায় একই উত্তর-- অসম্ভব উন্নাসিক মেজাজ। উত্তুঙ্গ স্টারডমটা এমনভাবে মাথায় ঢুকে গিয়েছিল রাজেশের যে এমন সিনিয়র পরিচালকদেরও উনি সেটে অপেক্ষায় রাখতেন। দেরি করে পৌঁছনোর জন্য কোনও দিন দুঃখপ্রকাশও করতেন না। শক্তি সামন্ত এবং হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়কেউই এই ধরনের ব্যবহার বরদাস্ত করতে পারতেন না। এতটাই খেপে গিয়েছিলেন শক্তি সামন্ত যে শেষের দিকে রাজেশ খন্নাকে চিনতেও অস্বীকার করতেন তিনি। “মৃত্যুর ক’দিন আগেই শক্তিদা’র সঙ্গে একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল,” বলছিলেন এক সিনিয়র পরিচালক। “রাজেশ খন্নার সঙ্গে ওঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা জানতে খুব আগ্রহী ছিলাম আমরা। আমাদের অবাক করে দিয়ে শক্তিদা বললেন তিনি রাজেশ খন্না সম্বন্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করবেন না। বলেছিলেন, যা ইচ্ছে জিজ্ঞেস করতে পার, কিন্তু রাজেশ খন্না সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন কোরো না। তারপর পার্টি ছেড়েই চলে গেলেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই লোকটাই রাজেশ খন্নার সঙ্গে অমর সব ছবি পরিচালনা করেছেন, আর এখন এই তাঁর সমীকরণ,” বলছিলেন সেই সিনিয়র পরিচালক। ইন্ডাস্ট্রির সত্যিকারের ‘বাবুমশাই’রা রাজেশকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন স্রেফ ওঁর দুর্ব্যবহারের জন্য।
|
|
কোন ‘বন্ধু’রা ওঁকে বিপথে নিয়ে গেলেন? |
‘বন্ধু’ হিসেবে যে দু’জনের নাম প্রথমেই মাথায় আসে তাঁদের প্রথম জন রাজেশের সমসাময়িক হিন্দি ছবির এক চরিত্রাভিনেতা, যাঁর কন্যা পরে খুব অল্প সময়ের জন্য হিন্দি ছবির নায়িকা হয়েছিলেন। অন্যজন সত্তর দশকের সামান্য পরিচিত ভিলেন, যাঁকে মাঝে মাঝেই ‘রেপ’ সিনে দেখা যেত। “দু’জনকেই প্রতি সন্ধ্যায় ওঁর বাড়িতে দেখা যেত। ওই দু’জন ছিলেন ওঁর এক গেলাসের বন্ধু। কোন ছবিটা ওঁর করা উচিত আর কোনটা নয়সেটা নিয়েও মতামত জানাতেন ওঁরা। এবং ওই দু’জনই ওঁর পতনের মূল কারণ,” বলছেন বরিষ্ঠ সাংবাদিক ইন্দ্রমোহন পান্নু। রাজেশের বহু দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কথাতেও বোঝা যায়, এই দু’জন রাজেশের চামচের বেশি আর কিছুই ছিলেন না।
এবং এঁরাই তাঁকে বলিউড ইন্ডাস্ট্রির সত্যটার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।
|
ঔদ্ধত্য ছিল কতটা? |
স্টারডমটা এতটাই ওঁকে প্রভাবিত করেছিল যে নিজের খুশি মতো সেটে আসতেন যেতেন। কল-টাইম মানা-টানার কোনও ব্যাপারই ছিল না। শ্যুটিং-য়ে যেতেনও না অনেক সময়ে। ওঁর বহুদিনের এক সহকারী বলছেন, “একটা সময় বি আর চোপড়া প্রতিদিন ফোন করতেন জিজ্ঞেস করতে যে ‘কাকা’ সেটে আসছেন না কেন। এক হপ্তা চলেছিল এই রকম। তার পর একদিন রাজেশকে সে কথা বলতে, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মুড হুয়া তো কাল যায়েঙ্গে।”
‘কাকা’-র ঔদ্ধত্যের এ রকম হাজার হাজার নমুনা বলিউডে কান পাতলেই শোনা যাবে। আরেকবার কাশ্মীরে একটা শ্যুটিংয়ে পৌঁছে পরের ফ্লাইটেই মুম্বই ফিরে এসেছিলেন রাজেশ কারণ সঙ্গে যে জুতোজোড়া ছিল, সেটা ওঁর অপছন্দ হয়েছিল, বলছেন ইন্ডাস্ট্রির বহু পুরনো এক কলাকুশলী। রাজেশ খন্না মানেই ছিল এই রকম উদ্ধত ব্যবহার। কয়েক বছরের জন্য বরুণ বর্ধন নামে এক চিত্রনাট্যকার রাজেশের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে ঘোরাফেরা করে রাজেশ খন্নার দুর্ব্যবহারের নানা গল্প। “আমার সারা জীবনে এত উদ্ধত আর কাউকে দেখিনি।
ইন্ডাস্ট্রিতে ওঁর পরে আসা সবাইকে উনি মানুষ জ্ঞানই করতেন না। শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন উনিই শ্রেষ্ঠতম,” বলছেন বরুণ।
|
কতটা খারাপ ছিল ওঁর শেষের দিকের ব্যবহার? |
ইন্ডাস্ট্রিতে একটা কথা সবাই বলেন। রাজেশ খন্নার স্টারডম চলে যাওয়ার পেছনে ছিল ওঁর খারাপ ব্যবহার। যে মানুষটা বাড়ির কাজের লোকেদের পর্যন্ত অত স্নেহ করতেন, তিনি তাঁর প্রযোজক, পরিচালক, সহ-অভিনেতাদের সঙ্গে অসম্ভব খারাপ ব্যবহার করতেন। এই খারাপ ব্যবহারটা শেষ পর্যন্ত উনি সাংবাদিকদের সঙ্গেও করতেন। প্রায় ৩০ বছর রাজেশ খন্নাকে কাছ থেকে দেখেছেন অজয় ব্রহ্মতমাজ। তিনিই শোনালেন রাজেশের দুর্ব্যবহারের গল্প। “একটা পার্টিতে একজন সিনিয়র অভিনেত্রী ওঁর কাছ থেকে ফোন নম্বর চেয়েছিলেন। রাজেশ খন্না অঙ্গভঙ্গি করে সবার সামনে ওঁকে বলেছিলেন, আমার একটাই ফোন নম্বর৩৬-২৪-৩৬। সেই অভিনেত্রী শুধু কাঁদতে বাকি রেখেছিলেন। শেষের দিকে এমনই ব্যবহার করতেন উনি,” বলছিলেন অজয়।
|
মিডিয়াকে কী ভাবে হেনস্তা করতেন? |
রাজেশ খন্না প্রথম দিন থেকেই অন্তর্মুখী ছিলেন। সাক্ষাৎকার দিতেন না সহজে। এমনকী সে সময়কার সেরা সাংবাদিকদেরও রাজেশের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে এক মাস অপেক্ষা করতে হত। “রাজেশ বোধহয় একটা স্যাডিস্টিক আনন্দ পেতেন সাংবাদিকদের অপেক্ষায় রেখে। কখনও কখনও সারা দিন বসিয়ে রাখতেন সাংবাদিকদের, আর নিজে মেক-আপ রুমে বসে মদ খেতেন,” জানাচ্ছেন বহু দিন বলিউড কভার করা একজন সিনিয়র মহিলা সাংবাদিক, যিনি প্রথম সারির একটি ম্যাগাজিনে কাজ করতেন। পরের দিকে মিডিয়া থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন রাজেশ। সাংবাদিকদের সঙ্গে কখনও কথা বললেও মিডিয়াকেই দোষ দিতেন অমিতাভ বচ্চনকে তোলার জন্য। “অমিতাভ বচ্চনকে ছোট করা ছিল রাজেশের সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। ‘আনন্দ’-এ তাঁর লম্বা সহ-অভিনেতা যে তাঁকে ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে গেছেন, এই ব্যাপারটা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজেশ মেনে নিতে পারেননি,” জানাচ্ছেন দেশের প্রথম সুপারস্টারের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। |
|