|
|
|
|
স্মরণ ১... |
‘আশীর্বাদ’-য়ের রাজা |
মানুষটা প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে করতেন চূড়াম্ত দুর্ব্যবহার। অথচ সেই মানুষটাই বাড়ির লোকের কাছে ঈশ্বর।
১৯৬৯-১৯৭৫। বলিউডে রাজেশ-রাজ। যেন এ সময়টার মধ্যেই জন্ম এবং মৃত্যু তাঁর। আশীর্বাদ তাঁর গমগমে প্রাসাদ। কত কাহিনি,
কত নাটক সেখানে। এই প্রথম রাজেশ খন্নার কুড়ি বছরের
বাঙালি সচিব প্রশান্ত রায় গোপন সব সিন্দুক খুলে দিলেন ইন্দ্রনীল রায়-এর সামনে |
১৯৭১-এর বৃষ্টিভেজা সকালে ঢুকেছিলাম ‘আশীর্বাদ’-য়ে। তার পরের ১৯ বছর ওটাই ছিল আমার ঠিকানা।
রাজেশ খন্নার সঙ্গে প্রযোজক, পরিচালক, ভক্তেরা এমনকী ইন্দিরা গাঁধী যিনিই কথা বলতে চান তাঁরা প্রথম ফোনটা আজীবন মুম্বইতে বড় হওয়া রাজেশ খন্নার সচিব প্রশান্ত — এই অধমকেই করতেন।
আর কী সব দিন দেখেছি! যখন শুরু করেছিলাম তখন দেখতাম রাত ন’টার পার্টি শেষ হচ্ছে পরের দিন সকাল ন’টায়। দেখেছি প্রযোজকরা এসে কাঁদছে কারণ ‘সাহেব’ তাদের ছবি সাইন করছে না। দেখেছি প্রতিবন্ধী মা রাতে কোলে বাচ্চা নিয়ে এসে বলছে “ডাক্তার বলছে ওকে পাগলা গারদে দিতে হবে, শুধু একবার রাজেশ খন্নার দর্শন করিয়ে দাও, তা হলেই ঠিক হয়ে যাবে’। পরে শুনেছিলাম সেই বাচ্চা ছেলেটা নাকি ঠিক হয়ে গিয়েছিল। পাগলা গারদে দিতে হয়নি তাকে। এক বৃষ্টিভেজা সকালে যে জৌলুস দেখেছিলাম আশীর্বাদে, তেমনই দেখেছি আরেক স্যাঁতসেঁতে সকালে রাজেশ খন্না এসে বলছেন, “কী এত কাজ করো আমার অফিসে বসে প্রশান্ত? এখন আমার নিজেরই তো তেমন কাজ নেই।”
সেই ক’বছর ভারতের অনেক সাংবাদিককে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আমি করিয়ে দিয়েছি। অনেককেই কাকার পাবলিসিটি স্টিলস পাঠিয়েছি। লাখ লাখ ফ্যান মেল সামলেছি। কিন্তু এই প্রথম আমার কথাগুলো মানুষের কাছে জানাচ্ছি। একজন সাধারণ সেক্রেটারিকেও রাজেশ খন্না স্টার বানিয়ে দিয়ে ছিলেন।
এই না হলে স্টারডম!
|
ওয়েল ডান |
সে দিন সকালে আমার অফিস পৌঁছতেই দেরি হয়েছে। এমনিতে রোজ দশটায় ঢুকতাম। সেদিন পৌঁছতে সাড়ে দশটা বেজেছে। গিয়েই শুনি পাগলের মতো অঞ্জু মহেন্দ্রু সমানে ফোন করে চলেছেন। আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন এল, “প্রশান্ত! কাকাজি কিধর হ্যায়?” আমি বললাম ম্যাডাম আমি তো কিছুই জানি না। এখুনি অফিসে এসেছি। অঞ্জুজি কিছুতেই মানবেন না। তার পর আধ ঘণ্টা পরে ফোন এল। অঞ্জুজি আবার। ‘‘প্রশান্ত, আমরা যে ওম প্রকাশের কাছ থেকে শুনেছি কাকাজি ববির হিরোইনের সঙ্গে খান্ডালাতে রয়েছে। আমি আর মা ক্যাপ্রি (তখন অঞ্জু মহেন্দ্রু একটা হলুদ ক্যাপ্রি গাড়ি চালাতেন, যা অনেক সিনেমাতেও ব্যবহার করা হয়েছে) নিয়ে যাচ্ছি। অঞ্জুর গলা শুনে মনে হল খান্ডালা পৌঁছে কাকাজির সঙ্গে দেখা হলে একটা যা তা কাণ্ড হবে। খান্ডালা গেলে রাজেশজি কোথায় থাকতেন আমি জানতাম। প্রথমেই ‘লাইটনিং কল’ বুক করে ফোন করলাম সেই হোটেলে। যত বার বলছি রাজেশ খন্নাকা রুম কো কনেক্ট করো, তত বার বলছে রাজেশ খন্না নেই এখানে। শেষে, মিথ্যে কথা বললাম। বললাম আমি ওঁর সেক্রেটারি। আমার মা খুব অসুস্থ। আমাকে এখুনি কলকাতা ফিরে যেতে হবে অন্তত এই মেসেজটা দিয়ে দিন। তার কিছুক্ষণ পরে ওঁর সঙ্গে যে ড্রেসার ছিলেন তিনি ফোন করলেন আমায়। আমি বললাম এখুনি মুম্বই থেকে অঞ্জু আর ওর মা রওনা হয়েছে। খান্ডালাতে তোমাদের হোটেলে যাচ্ছে। বিকেলে শুনেছিলাম অঞ্জুরা পৌঁছোনোর আগেই ওখান থেকে ভাবিজিকে (তখনও বিয়ে হয়নি যদিও) নিয়ে মুম্বই ফিরে এসেছিলেন কাকাজি। এসে সোজা আমায় অফিসে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “ওয়েল ডান প্রশান্ত। ম্যায় শাদি কর রহা হু”।ঁ ডিম্পলকে দেখিয়ে বলেছিলেন ‘‘আজ সে ইয়ে তুমহারা ভাবি হ্যায়”। তার দু’সপ্তাহের মধ্যেই জুহুর হোটেল হরাইজনে বিয়ে হল। যাতে পনেরোশো লোকের নেমন্তন্নর কার্ড সময় মতো পৌঁছোয় তার জন্য পোস্ট মাস্টার জেনারেলকে বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এতটাই ক্ষমতা ছিল তখন ওঁর ‘স্টারডম’এর।
|
বহুত সাথ দিয়া হ্যায় |
সেই ‘স্টারডম’এর কথা মনে আসছিল গত সোমবার। দুপুরের দিকে শুনলাম, হসপিটালে ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন তাই রাজেশ খন্না ফিরে আসছেন বাংলোতে। ছুটলাম আশীর্বাদ। আজকে তো ওয়াচম্যান সিকিওরিটি সব পাল্টে গেছে। গেটে এসে একটা ছোট চিঠি লিখলাম। বললাম বাড়ির কাউকে দিয়ে দিও। ওরা আমায় চেনেন। আমি এখানে ১৯ বছর কাজ করেছি। পনেরো মিনিটের মধ্যে ডিম্পল ভাবিজির ফোন এল। ‘‘প্রশান্ত জলদি বাংলো ওয়াপস আও”। ফিরে এলাম আশীর্বাদ। ভিতরে ওঁর ঘরে নিয়ে গেলেন ভাবিজি। শুয়ে ছিলেন। দেখলেন আমাকে। ভাবিজি কানে কানে বললেন, “প্রশান্ত আয়া হ্যায়”। ডাকলেন। হাতটা ধরলেন। অনেকক্ষণ হাতের ওপর হাত বোলালেন। একটু একটু কথা বলছিলেন। ভাবিজি আমার বাঁ দিকে দাঁড়িয়েছিলেন। ইশারা করলেন ভাবিজির দিকে। হালকা গলায় বললেন, “ইয়ে আদমি মেরা বহুত সাথ দিয়া হ্যায়। ইসকো দেখনা। টেক কেয়ার অফ হিম।” ততক্ষণে ডিম্পলজিও কাঁদছেন। আমিও কাঁদছি। সেদিন ‘চৌথা’তে দেখা হয়েছিল ভাবিজির সঙ্গে। আমাকে বললেন, “কাকা বলে গেছে তোমায় দেখতে। আমি সব মিটে গেলে তোমায় ফোন করব।”
এমন মানুষ ছিলেন রাজেশ খন্না। আমি বহু বছর ইন্ডাস্ট্রিতে, কিন্তু ওই মন কারও দেখিনি। আর হয়তো দেখবও না।
|
|
রুটিতে ঘি লাগানো আছে তো |
এক সময় আশীর্বাদে প্রায় ৩৬৫ দিন কোনও না কোনও কাজ হত। হয় নতুন ফার্নিচার বানানো হচ্ছে। নয় পাথর বসানো হচ্ছে। এক দিন আমায় ডেকে পাঠালেন। বললেন, “আমার এখানে মিস্ত্রিরা যে কাজ করে তারা খায় কী?” আমি বললাম ওরা তো নিজেরা খাবার নিয়ে আসে। শুনে নিজে জিভ কাটলেন। “এটা হতেই পারে না। ওরা রাজেশ খন্নার বাড়িতে কাজ করছে। রাজেশ খন্না যা খাবে ওদেরও কালকে থেকে তাই খাবার দিও।” এর পর যত দিন আমি ছিলাম, বাড়িতে কোনও মিস্ত্রি কাজ করলে দুপুরে আমার একটা রুটিন কাজ ছিল কিচেনে গিয়ে দেখা মিস্ত্রিদের রুটিতে ঠিক করে ঘি লাগানো হচ্ছে কি না। পরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম এই বাহুল্য কেন করছেন আপনি? আমাকে বলেছিলেন, “প্রশান্ত আমার এই যশের পিছনে কত মানুষের দুয়া আছে জান? তাঁরা আমার জন্য দুয়া করেছেন কিন্তু আমি তাঁদের চিনিও না। তাঁদের জন্য কিছু করতেও পারি না। আজকে যে মিস্ত্রিরা আমার এখানে কাজ করতে আসে তাদের মাছ, মাংস খাইয়ে আমি এই ঋণ থেকে একটু মুক্ত হতে চাই।” এটা শোনার পর আমি আর কথা বাড়াইনি। আশীর্বাদে কাজ করতে আসা প্রত্যেকটা মানুষ যেন ঠিক মতো খেতে পায় সেটার খেয়াল রেখেছি।
|
রাজেশ খন্না কভি ডিসকাউন্ট নেহি লেতা |
এরকম রাজকীয় মনের পরিচয় আমি বহু বার পেয়েছি ১৯ বছরে। ওঁর বাড়ির জন্য প্রায়ই নতুন এসি লাগত। নতুন গাড়ি লঞ্চ হলেই শোরুম থেকে লোক আসত। সবাই আমার সঙ্গেই কথা বলত। আমি নেহাত মধ্যবিত্ত বাঙালি। অভ্যেস মতো জিজ্ঞেস করতাম ডিসকাউন্ট কত দেবে তোমরা। একদিন এরকম এক দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ শুনলাম আমাকে চেঁচিয়ে ডাকছেন রাজেশজি। গেলাম। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে কথা বলছিলাম। বললাম, গাড়ির শোরুমের মালিকের সঙ্গে। ওঁরা বলছিলেন ১৫ লাখ টাকার একটা গাড়ি এসেছে। ডিসকাউন্টও দেবে কিছু। সঙ্গে সঙ্গে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আমাকে প্রায় ভর্ৎসনার ঢঙে বললেন, “তুমকো শর্ম নহি আতি। রাজেশ খন্না কভি ডিসকাউন্ট কা সামান নহি লেতা হ্যায়। ঔর দম হ্যায় তো পুরা প্যায়সা দেকে খরিদো ওয়ারনা মত খরিদো।” তার পর থেকে আমি আর কোনও দিন ডিসকাউন্টের কথা বলিনি ওঁর হয়ে।
|
আই হেট টিয়ারস |
আর একটা ঘটনা বলি। তখন ১৯৭৮-’৭৯ হবে। বাড়িতে কাজ করার একটা ছেলে এসেছিল। এমনিতে খুব সৎ, কিন্তু রাত হলেই চরস খেত। বাড়ির অন্য কাজের লোকেদের মাধ্যমে জানতে পারলেন ছেলেটা সৎ কিন্তু চরস খায়। একদিন আমাকে ডাকলেন বেডরুমে। বললেন, “শুনেছি নতুন ছেলেটা চরস খায়।” আমি বলললাম “হ্যা”।ঁ তখন বললেন, “শুনেছি যারা নেশা করে, নেশা করার টাকা ফুরিয়ে গেলে তাদের মতো মনোকষ্ট কারও হয় না পৃথিবীতে। তুমি ওকে বাজার করার টাকা দিলে একশো টাকা করে বেশি দেবে। ৫০০ টাকার সব্জি কিনলে, ৬০০ টাকা দেবে। আমি কথা মতো তাই দিতাম। একদিন সকালে কাকাজি বেরোচ্ছেন। হঠাৎ দেখলাম সেই ছেলেটা এসে রাজেশজির পায়ে পড়ে কান্নাকাটি করছে। সবাই ছুটে এলো দেখতে। কান্না থামিয়ে ছেলেটি বলল, “আমি খবর পেয়েছি আমার চরসের জন্য আপনি একশো টাকা করে বেশি দেন আমায়। আমি এরকম মালিক কোনও দিন দেখিনি। কালকে রাত থেকে এটা শোনার পর আমি চরস ছেড়ে দিয়েছি।” ততক্ষণে সবার মুখে হাসি... কাকা গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন, “ব্যস আভি মন লগাকে কাম করো আউর রোনা মাৎ, আই হেট টিয়ারস,” বলে হাসতে হাসতে চলে গেলেন তিনি।
|
কোনও দিন আসতে দেখিনি অমিতাভকে |
কিন্তু এত দিন যে আশীর্বাদে ছিলাম, একটা লোককে কোনও দিনও আসতে দেখিনি। তাঁর নাম অমিতাভ বচ্চন। যেদিন চলে গেলেন, আশীর্বাদে অমিতাভকে দেখে তাই আমি চমকেই গিয়েছিলাম। ভাবিনি উনি আসবেন।
এমনিতেই যখন সেলস ট্যাক্সের অফিসে জুনিয়র ক্লার্কের কাজ ছেড়ে রাজেশ খন্নার সচিব হলাম আমাকে সাহেব প্রায়ই নিয়ে যেতেন মোহন স্টুডিওতে ‘আনন্দ’এর সেটে। আলাপও করিয়ে দিয়েছিলেন অমিতাভের সঙ্গে। তখন অমিতাভকে কেউ চেনে না। তারপর তো সময়টা বদলাতে শুরু করল। অমিতাভ ধীরে ধীরে অমিতাভ বচ্চন হয়ে উঠলেন। ‘নমক হারাম’এর সময় মনে আছে দু’জনের মধ্যে বিস্তর মনোমালিন্য হয়েছিল। সংলাপ নিয়ে, সিন নিয়ে, প্রায়ই রাজেশজির সঙ্গে বচসা হত হৃষীদার। কিন্তু তত দিনে অমিতাভ বচ্চনের জোর বাড়তে শুরু করেছে ইন্ডাস্ট্রিতে।
অনেক পরে একদিন বিকেলে আমায় ‘নমক হারাম’এর সব গল্প বলছিলেন। বলছিলেন খুব মন খারাপ হয়েছিল তাঁর অমিতাভ আর হৃষীদার ব্যবহারে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পর আর কোনও দিন কিছু বলতে শুনিনি। শুধু একটাই কথা বলতেন বার বার, “লোগ মুঝে সমঝ নহি পায়ে। ম্যায় মানি মাইন্ডেড নহি হুঁ, ম্যায় কলাকার হুঁ। অত হিসেবনিকেশ করে জীবন আমি কাটাতে পারব না।” হিসেবনিকেশ করে জীবন কাটাতে পারেননি বলেই ‘রোটি’র আউটডোরে ৭০ জন বন্ধুকে নিজের পয়সায় কাশ্মীর নিয়ে গিয়েছিলেন, রেখেছিলেন টপ হোটেলে। তাঁর আগেও কোনও হিরো এমন করেননি। তাঁর পরেও কাউকে এমন করতে দেখিনি।
|
পঞ্চম মেরা কলিজা হ্যায় |
সেই সব দিন একেবারে অন্য রকম ছিল। তখন রাত ন’টা হলেই শুনতাম হাঁক পড়েছে বাড়ির চাকরদের, “শুনো শক্তিদা ( শক্তি সামন্ত) আ রহে হ্যায়। মেরা ট্রে রেডি কর দো।” সেই মেহফিল অনেক রাত অবধি চলত।
মাঝে মাঝে কিশোরদা আসতেন। এমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল কিশোরদার সঙ্গে যে কোনও দিন চাইতেন না তাঁর গলায় অন্য কেউ গান গাক। প্রযোজক যদি মহম্মদ রফিকে দিয়ে ঠিক করতেন গাওয়াবেন তা হলে কিছু বলতেন না। কিন্তু মনে মনে খুশি হতেন না একদমই। কিশোরদা ছিলেন রাজেশ খন্নার দুর্বলতা। সারা রাত তখন চলত গানের আড্ডা। পঞ্চম তো প্রায় রোজ আসতেন। পঞ্চম যে দিন আসতেন সে দিন কাকাজির মন সন্ধে থেকেই ভাল। খালি বলতেন, “পঞ্চম মেরা কলিজা হ্যায়।” কত রাত অবধি চলত আড্ডা। দেখতাম সব চুপিচুপি। পঞ্চমের সঙ্গে একদিন আড্ডা চলছে। মদ-মাংস কোনও কিছুর কমতি নেই। হঠাৎ করে রাজেশ খন্না অভিমানী হয়ে গেলেন। “পঞ্চম, তু ‘রাজা রানী’ মে অচ্ছা মিউজিক নহি দিয়া”। একটু পরে আড্ডা শেষ হল। কিন্তু পঞ্চমের বোধহয় খারাপ লেগেছিল। পরদিন সকাল সাতটায় এসে গেটে হর্ন শুনে গিয়ে দেখলাম পঞ্চম। বললেন, “কিধার হ্যায় নবাব”। ঘরে গিয়ে নিজেই তুললেন রাজেশকে। “কাল রাতে খুব তো বলছিলে খারাপ সুর দিয়েছি। এই নাও একটা নতুন সুর বানিয়েছি না ঘুমিয়ে তোমার জন্য”। কাকা বললেন “শুনাও।” আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে। গানটা ছিল, ‘শুনো, কহো, কাহা, শুনা’....
|
শুধু চা আর খাবার দিতে থাকো |
সব ঠিক ছিল, কিন্তু মিডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে কোনও দিন সেরকম উৎসাহী ছিলেন না। আসলে, উনি যে ভীষণ মুডি ছিলেন তার সব চেয়ে বেশি প্রমাণ আমি পেতাম যখন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় আসত। সেই সময়ের নামকরা সাংবাদিকের অনেকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করতে হত আমায়। তাঁরা হয়তো আশীর্বাদে এসে অপেক্ষা করছেন কিন্তু সাহেবের দেখা নেই। অনেক সময় আমি নিজে ওপরে গিয়ে বলতাম অমুক এসেছেন ইন্টারভিউ নিতে। আমাকে বলতেন, “আমার একদম মুড নেই। এমন মনের অবস্থায় আমি সেটে গিয়ে সংলাপই বলতে পারব না, ছাড়ো তোমার ইন্টারভিউ। বসিয়ে রাখো জার্নালিস্টকে। তিন চার ঘণ্টা পরে নিজেই বুঝে যাবে যে ইন্টারভিউ দেব না। শুধু আধ ঘণ্টা অন্তর চা আর খাবার দিতে থাকো।” আমি ওঁর আদেশ পালন করতাম। তবে একজন সাংবাদিকের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক দারুণ ছিল। দেবযানী চৌবাল। দেবীর সঙ্গে মনোমালিন্য হত । ঝগড়া হত চূড়াম্ত কিন্তু তাও দেবীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট কখনও ক্যানসেল করতেন না।
|
পাপে তুসি তোপ হো |
এ রকম কাজকর্ম, গান, আড্ডা, হাসি-ঠাট্টায় তখন ভরে থাকত আশীর্বাদ। কোনও দিন কারও মনেই হয়নি যে এমন দিনও আসবে যখন শুধু ফালতু লোকের ভিড় হবে এই আশীর্বাদে। সেটাও চোখের সামনে দেখা। আজকে মানুষটা নেই কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারি। একটা সময় ছিল যখন শক্তিদা, হৃষীদা, কিশোরদা, পঞ্চমদা, দুলাল গুহ, অসিত সেন, মুকুল দত্ত, শর্মিলা ঠাকুর এঁরা ঘিরে রাখতেন রাজেশ খন্নাকে। তাঁদের মধ্যে একটা কালচার ছিল, ডিসিপ্লিন ছিল। সেটা রাজেশ খন্নাকে ‘রাজেশ খন্না’ হতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু তার পর কে জানে কী হল। বাঙালিদের এই গ্রুপটা ধীরে ধীরে আসা বন্ধ করে দিল। তার বদলে ঢুকল কিছু ব্যর্থ পাঞ্জাবি অভিনেতা ও প্রযোজক। তাদের কাজ ছিল রাজেশ খন্নাকে শুধু তোল্লাই দেওয়া। ওদের মদের আসরে ঘুরে ঘুরে খালি একটাই কথা কানে আসত।, “পাপে তুসি তোপ হো”। বাঙালি গ্রুপটার চলে যাওয়া আর এই পাঞ্জাবি গ্রুপটার চলে আসাই কাল হল। ওরাই ধীরে ধীরে শেষ করে দিল সাহেবকে।
|
|
ডিম্পল গয়ি, পাঁচ ঔর আয়েগি |
এর মাঝখানে হল ডিম্পলের সঙ্গে সেপারেশন যা রাজেশ খন্নাকে খতম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
একটু পেছন ফিরে তাকালে আজও সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে আছে, যখন ওদের প্রেম-পর্ব চলছে, তখন ডিম্পল প্রায়ই ফোন করতেন। আমি ধরতাম ফোন। দিনে কারা কারা ফোন করত সব নোট করে রাখতাম আর কাকা শু্যট থেকে ফেরার পর লিস্টটা দিয়ে দিতাম। এক দিন অনেক বার ফোন করেছিলেন ডিম্পল। রাতে কাকাকে বললাম, ডিম্পল বলে এক জন ফোন করেছিল অনেক বার। শুনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বলেছিলেন, “উহ ‘ববি’ পিকচার কা হিরোয়িন হ্যায়, উসসে অচ্ছে তারিখে সে বাত করনা।” তার পর তো বিয়ে হল। ডিম্পলও তখন বাচ্চা মেয়ে। সারাদিন বাড়িতে কী দৌরাত্মটাই না করতেন। গুলি খেলতেন ছাদে চাকরদের সঙ্গে, সেলাই করতেন নিজের মনে। কখনও আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করে বলতেন, “প্রশান্ত, তোমার স্কুটারে করে আমায় লিংকিং রোডে নিয়ে চল”। আমি বলতাম, আপনি মিল মালিক চুনিলাল কাপাডিয়ার মেয়ে। রাজ কপূরের হিরোইন, রাজেশ খন্নার বউ। আপনাকে স্কুটারের পেছনে বসালে আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। শুনে খুব হাসতেন। এর মাঝখানে দু’টো ফুটফুটে মেয়ে হল। বাচ্চাদের সব কাজ নিজে হাতে করতেন। তার পর জানি না কী হল। একদিন হঠাৎ মেয়েদের কোলে নিয়ে সকাল বেলা বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।
আর সেটার সুযোগ নিয়ে ঢুকল কিছু থার্ড গ্রেড অভিনেতা আর প্রযোজক। কোথায় দু’জনকে মেলাবে, না তারা এসে উল্টো কথা বলা শুরু করল। “কাকাজি আপ কৃষ্ণ ভগবান হ্যায়, এক ডিম্পল গয়ি, পাঁচ ঔর আয়েগি।”
আমার শুনে খুব কান্না পেত কিন্তু বলতে পারতাম না কিছুই। সেই পাজি, মাতালদের দল শেষ করে দিল সব। আশীর্বাদ-এর সব আনন্দ ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল। যেখানে বিদেশি দামি গাড়ির লাইন থাকত সেখানে এই সব বাজে লোকেদের ফিয়াট দেখা যেত। সবাই মিথ্যে বলে বলে টাকা নিয়ে যেত কাকাজির কাছ থেকে। আমার আর ভাল লাগছিল না ।
|
জিন্দেগি কিতনা বদল গয়া হ্যায় রে |
তত দিনে রাজেশ খন্নাও ধীরে ধীরে একা হয়ে গিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ঠিক করলেন রাজনীতিতে যাবেন। তখন বেশির ভাগ সময়ে দিল্লিতে কাটাতেন। আমারও তেমন কাজ থাকত না আর। বুঝতে পারতাম পুরো আশীর্বাদ বাংলোটা আমায় যেন গিলতে আসছে। মাঝে মাঝে সন্ধেবেলা কথা হত। দেখতাম কথা বলতে বলতে সাহেবের চোখে জল। আমাকে কাজ করতে দেখে বলতেন, “জিন্দেগি কিতনা বদল গয়া রে প্রশান্ত”।
চাইতেন ফিরে পেতে তাঁর স্টারডম। অনেক জ্যোতিষীকে ডেকে পাঠাতেন। কেউ বলত মার্বল লাগালে কপাল ফিরবে। রাজস্থান থেকে সেরা মানের মার্বল নিয়ে আসা হল। তার পরেও সে রকম কাজ এল না। তখন আরেক জ্যোতিষী এসে বললেন, মার্বল লাগানোর জন্যই এই অবস্থা। লাখ লাখ টাকার সেই মার্বল আবার তুলে ফেলা হল। তার মধ্যেও পুরনো চাকর-ভৃত্যদের বিয়ের জন্য টাকা দিয়েছেন, আমাকে আমার বিয়ের জন্যও টাকা দিয়েছিলেন। শুধু বলেছিলেন, বিয়েতে পণ যেন না নিই। ‘দহেজ’ নিলে চাকরি থেকে বার করে দেবার কথাও বলেছিলেন।
|
মেরা হ্যায় কৌন |
ধীরে ধীরে আরও একা হয়ে পড়লেন। আমারও প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছিল। আমিও অন্য জায়াগায় চলে গেলাম। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর, ওঁর জন্মদিনে ফোন করতাম, কথা বলতাম। শেষ পাঁচ-ছ’ বছর প্রায়ই ফোন করতেন। ফোন করে বলতেন, “কী প্রশান্ত, বড় ভাই যখন গরিব হয়ে যায়, তখন ছোট ভাই কি তাকে ত্যাগ করে দেয় নাকি?” শুনে আমি কেঁদে ফেলতাম। বলতাম, না, না সাহেব, আমি আসব আপনার কাছে। শুনে হাসতেন। বলতেন, আয়, একদিন আগের মতো আড্ডা মারি, গল্প করি। বছর দুই আগে একদিন হঠাৎ ফোন করলেন। অনেক পুরনো দিনের মানুষদের কথা বলছিলেন। বলছিলেন কারা সব আমার বন্ধু ছিল বল। এমন বন্ধু থাকা কপালের ব্যাপার। আমি শুনছিলাম। শেষে বললেন, “মেরা হ্যায় কৌন, আকেলাপন কে ইলাওয়া কোই মেরা নেহি হ্যায়।” সেদিন ফোন রেখে খুব মন খারাপ হয়েছিল। পরের দিন ভগবানকে বলেছিলাম, যেন অন্তত আর একটা দিন আসে যেদিন ভারতবর্ষকে আর একবার মনে করিয়ে দেওয়া যায়, কত বড় স্টার ছিলেন রাজেশ খন্না।
ভগবান আমার কথা শুনেছেন। মৃত্যুই প্রমাণ করল রাজেশ খন্না আজকেও কতটা জীবন্ত আমাদের মধ্যে।
তাও আফসোস একটা থেকেই যায়। উনি দেখে যেতে পারলেন না সুপারস্টারের যাওয়া কাকে বলে।
সেটা দেখতে পারলে হয়তো সেই কথাটা আমায় শুনতে হত না... “মেরা হ্যায় কৌন...” |
|
|
|
|
|