প্রতি পক্ষ
চক্ষে আমার তৃষ্ণা...
প্রিল মাসটিই নিষ্ঠুরতম, লিখেছিলেন টি এস এলিয়ট। কেন, তার একটি কাব্যিক ব্যাখ্যা আছে। এই নিরক্ষীয় অঞ্চলে কেন এপ্রিল ভয়ঙ্কর, তার একটি বাস্তবিক ব্যাখ্যা আছে।
গরম।
সেই গরম যখন এই কৃপণ বর্ষার আবহে জুলাই পর্যন্ত গড়াল, এবং এখনও তার কবল থেকে নিষ্কৃতির কোনও আশু ইঙ্গিত নেই, তখন ‘সিমা’ গ্যালারির চলতি ‘সামার শো’ প্রলম্বিত নিদাঘে তৃষ্ণার শান্তি।
আসলে, দৃশ্যের তৃষ্ণা। দৃশ্য-রূপের তৃষ্ণা। নবীন ও প্রবীণে গড়া শিল্পী তালিকায় রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, থোটা বৈকুণ্ঠম, গণেশ পাইন, সুহাস রায়, যোগেন চৌধুরী, লালুপ্রসাদ সাউয়ের মতো শ্রুতকীর্তিরা আছেন, আছেন রশ্মি বাগচি সরকার, সুমিত্র বসাক, রাউল হেমন্ত-র মতো নবীন প্রতিশ্রুতি। মাঝের বয়ঃক্রমে সিমা গ্যালারির দেওয়াল আলো করে পরেশ মাইতি, চিন্তন উপাধ্যায়, শাকিলা, রিনি ধুমল এবং আরও অনেকে। নিছক তালিকা প্রদান এই লেখার বিষয় নয়, কিন্তু এ কথা নিশ্চিত যে সমকালীন ভারতশিল্পের এক টুকরো দর্পণ হয়ে রইল এই প্রদর্শনী।
তাতে দুই অর্থে দর্শকের লাভ। এক, তিনি দেখবেন কী ভাবে চেনা শিল্পীর অদেখা কাজ সামনে উপস্থিত। চিন্তন-এর ‘ডিজাইনার বেবি’ কে না দেখেছেন! কিন্তু, তাকেই আরও এক বার দেখা। বা, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্চর্য রং ও রেখায় গড়া ভারতীয় ‘ফিগার’গুলিও চেনা! তবু, আশ্চর্য স্বাদু রন্ধনের মতোই সেই বস্তুটি পুরনো হয় না! আরও এক বার দেখতে ইচ্ছে করে। একই কথা বলা চলে, পরেশ মাইতির অলৌকিক জলরংয়ের বিস্তারে নিসর্গ দৃশ্য বা যোগেন চৌধুরীর শিল্পিত ভাঙচুরে গড়া অবয়বের প্রসঙ্গে। পরিচিত ছাঁচ, কিন্তু প্রতিটি দর্শনেই অন্যতর পরিচয়!
দ্বিতীয় লাভটিই বঙ্গীয় দর্শকের পক্ষে অধিকতর। আবিষ্কারের আনন্দ। তিমির ব্রহ্ম যখন ‘হনি-মেন’-এ ন্যানো-সদৃশ একটি চলন্ত গাড়িতে সহাস্য এক দম্পতির ছবি আঁকেন, তখন তা হয়ে ওঠে সুখী ভারতের বিচিত্র চলচ্ছবি! বস্তুত, সেই তথাকথিত সুখের উদ্দেশে শিল্পীর একটি মন্তব্যই যেন বা! এর মধ্যে নিহিত আছে একটি বিদ্রূপ।
প্রকৃত পক্ষে নতুন শিল্পীদের কাজে বারংবার ছায়া ফেলে এই বিদ্রূপ।
উত্তর-আধুনিক বিদ্রূপ। কেননা, তাঁরা শুধু নির্মাণটি দেখিয়েই ক্ষান্ত হন না, বরং সেই নির্মাণের বিভিন্ন সূত্র কী ভাবে জুড়েছে একের সঙ্গে অপর, তাও দেখা দেয় তাঁদের কাজে। যেমন, ধরা যেতে পারে, কালিকলমে সত্যজিৎ রায়ের ‘পাখি’। ‘বার্ড থ্রি’ ছবিটিতে যেমন কিম্ভূত একটি পক্ষীর অবয়ব। বিচিত্র জোড়াতালিতে গড়া তার শরীর। যতই দু’টি ডানা দু’রকম বা মোটা একটি লেজ থাক, আমরা জানি, আসলেতে পাখি সে কিন্তু, আমরা জানি না, সে আসলে প্রাণ না যন্ত্র! দু’টি পা থেকে বেরিয়ে থাকা স্প্রিং তৈরি করে এমন বিভ্রম!
এ যদি বিদ্রূপের একটি ধরন হয়, তা হলে সৌগত দাসের ‘মিরর এচিং’-এ ‘এক্সপ্রেশন’ সিরিজ কি আসলে অভিব্যক্তিবাদের প্রতিই একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য! অদ্ভুত সব মুখভঙ্গি! এ কি নিছকই ব্যঙ্গচিত্র? নয়। অথচ, ব্যঙ্গচিত্রের ‘ফর্ম’টিকে আশ্রয় করে তিনি নির্মাণ করেছেন নতুন শিল্পরূপ। তাতে তিনি এই সময়ের স্বভাবজ অতিরেকটিকেই তুলে ধরতে চান যেন!
কার্ডবোর্ডের একটি খুলে ফেলা বাক্সের মধ্যে যুদ্ধ ও শান্তির ছলাকলা দেখিয়েছেন অনির্বাণ ঘোষ। সার্কিট বোর্ড-এর মতো তার চেহারা! মনে হয়, এই দু’টি শব্দ, যুদ্ধ ও শান্তি, যদিও একে অন্যের বিপরীত বলেই পরিচিত, তবু গভীরে কোথাও লুকিয়ে আছে কোনও চোরা টান যা জুড়ে রাখে একের সঙ্গে অন্যটিকে!
আবার, ধরা যাক অঞ্জু চৌধুরীর ‘ব্লো উইন্ড ব্লো’ ক্যানভাসের গায়ে ‘ফর্ম’ এবং ফাঁকা জায়গার মধ্যে একটি অদ্ভুত যাতায়াত। কোথাও কিছু আছে। কোথাও কিছু নেই। ফাঁকা। সাদা। সেই দোলাচলের মধ্যে, বস্তু এবং শূন্যতার মধ্যে একটি সংলাপ তৈরি করেছেন শিল্পী, যার মধ্যে তিনি ছেড়ে রেখেছেন বাতাস চলাচলের পথ। পথ দিয়ে কে যায় গো চলে, তা দর্শকের কৌতূহলের কারণ হতেই পারে।
আসলে, এই পথ-চাওয়াতেই দর্শকের আনন্দ! সে পথের এক-একটি বাঁকে এক-এক রকম বিস্ময়। সুহাস রায়ের অনন্য আলোছায়ায় ‘রাধা’, শাকিলার কোলাজ-এ সময়ের প্রতিচ্ছবি বা গণেশ পাইনের নিজস্ব রহস্যময়তা চেনা ভাবের অনুরণন জাগায়। আবার, রাউল হেমন্ত-র কাজে নানা জিনিসের ভিড়ে একটি শরীরের আদলে ফাঁকা জায়গা মনে করিয়ে দেয়, কেউ যেন ছিল, এখন আর নেই!
কে ছিল? কে নেই? ভাবতে গিয়ে ঘনিয়ে ওঠে নানাবিধ প্রশ্ন।
তার মধ্যে জুড়ে যায় দেশ, কাল! জুড়ে যায় সাফল্য ও ব্যর্থতা! পরিহাস এবং বিষণ্ণতা!
উন্নতি এবং উন্নয়নের এই মায়া প্রপঞ্চময়, প্রশ্ন না করে তাকে গ্রহণ করা যাবে না, জানিয়ে দিল এই গ্রীষ্মকালীন শিল্পায়ন।
দর্শকেরা শুনলেন কি?




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.