জাগরী বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতো, রাজারাম সোরেনদের মতো সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে চান বিক্রমও। শুধু তাই নয়, একবার হলেও দেখা করতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে।
ধৃত মাওবাদী শীর্ষ নেতা বিক্রম ওরফে অর্ণব দামের আইনজীবী সাগর মণ্ডল মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছেন। বস্তুত, নিজের আইনজীবীর মাধ্যমেই বিক্রম এমন নানা বার্তা দিয়েছেন সাংবাদিকদের। জঙ্গলমহলে ‘রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে’ নিহত সিপিএম, তৃণমূল এবং মাওবাদী সদস্যদের পরিবারের কাছে বিক্রম ক্ষমা চেয়েছেন বলেও সাগরবাবু জানান। তাঁর কথায়, “অর্ণব দাম আমাকে বলেছেন, এ জন্য তিনি ‘অনুতপ্ত’ ও ‘লজ্জিত’। বর্তমানে মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি সুস্থ জীবনে ফিরতে চান।”
সাত দিন পুলিশ হেফাজতে থাকার পরে এ দিন কড়া পুলিশি প্রহরায় বিক্রমকে পুরুলিয়ার মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে হাজির করানো হয়। বিচারক তাঁর জামিনের আবেদন খারিজ করে তাঁকে সাত দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নে বিক্রমের সংক্ষিপ্ত জবাব, “যা বলার আমার আইনজীবীই বলবেন।” আইনজীবী জানান, বিক্রম তাঁর মাধ্যমে কয়েকটি বার্তা দিতে চান। সাগরবাবু বলেন, “অর্ণব আমাকে জানিয়েছেন, তাঁকে এক বার মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দিলে ভাল হয়। তবে তাঁদের তিনি কী বলবেন, তা জানাননি।” |
পুরুলিয়া আদালতে বিক্রম। নিজস্ব চিত্র |
সমস্যা একটাই। জাগরী, সুচিত্রা, রাজারামেরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। কিন্তু, বিক্রমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর পরে মাওবাদীদের রাজ্য কমিটির এই সদস্যের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, “উনি যদি মূলস্রোতে ফিরতে চান, ভেবে দেখা যেতে পারে।”
পুরুলিয়ায় যখন মূলস্রোতে ফেরার বার্তা দিচ্ছেন বিক্রম, তখন আসানসোলে উত্তরধাদকার লালবাংলা সংলগ্ন এলাকায় একটি ছোট্ট অসম্পূর্ণ ইটের বাড়িকে ঘিরে মঙ্গলবার সকাল থেকে তুমুল জল্পনা। জল্পনার কারণ, আসানসোল শহরের উত্তরপ্রান্তে নতুন বসতি গজিয়ে ওঠা এই এলাকায় দেড় কাঠা জমি কিনে ওই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন দীনেশ কুমার নামের রোগাসোগা যে যুবক, তিনিই মাওবাদী নেতা বিক্রম বলে দাবি করছেন এলাকার লোকজন। এই এলাকা থেকে ১৭ কিমি দূরের অজয় নদ পার হলেই বীরভূম বা ঝাড়খণ্ড।
স্থানীয় কিছু বাসিন্দার দাবি, গত বছর শীতের গোড়ায় ২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে একটি কুয়ো খোঁড়ার কাজে এক আদিবাসী যুবকের সঙ্গে বিক্রম এসেছিলেন। নিজের পরিচয় দেন দীনেশ কুমার বলে। জানান, বাড়ি পুরুলিয়ায়। এলাকার জমি কারবারি রাম সিংহের কাছ থেকে ওই যুবক দেড় কাঠা জমি কেনেন। রামবাবুর কথায়, “১৭ জুলাই টিভিতে বিক্রমের ধরা পড়ার ছবি দেখে চমকে ওঠে আমার মেয়ে। সেই আমাকে বলে, বাবা ওই তো দীনেশ! এখন বিশ্বাসই হচ্ছে না, এতবড় মাওবাদী নেতা এতদিন আমাদের এখানে লুকিয়ে ছিলেন।” প্রতিবেশীদের বক্তব্য, সপ্তাহদুয়েক আগে থেকে হঠাৎই বেপাত্তা হয়ে যান ওই যুবক। রামবাবু জানান, জমির দাম বাবদ ডিসেম্বরে দীনেশ
৭৮ হাজার টাকা দিলেও রেজিস্ট্রেশনের হাজার ছয়েক টাকা এখনও বাকি রয়েছে। পরে দেবেন বলেছিলেন। ৬ মার্চ আসানসোল রেজিস্ট্রি অফিসে দীনেশ কুমারের নামে উত্তরধাদকা মৌজার ওই জমি রেজিস্ট্রেশন (নম্বর ২৫৩৫) হয়। এ ধরনের রেজিস্ট্রিতে ক্রেতা-বিক্রেতার হাতের ছাপ ও ছবি আবশ্যক। পুলিশ অবশ্য এখনও রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে নথিপত্র দেখেনি।
ওই বাড়িতেও যায়নি। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসিপি সুনীল যাদব বলেন, “এ ব্যাপারে আমাদের কেউ কিছু জানায়নি। তাই খোঁজ নেওয়া হয়নি।”
এ দিন সকালে বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেল, রান্নাঘর-সহ তিনটি ঘর। অ্যাসবেস্টসের ছাউনি চুরি হয়েছে। দরজা-জানলাও। বাড়ির ভিতরে দেওয়াল জোড়া ছবিব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কালী, হনুমানের। মার্কস বা মাও জে দং কোথাও নেই।
বাড়ি লাগোয়া জমিতে ঢেঁড়শ ও ঝিঙে চাষ করেছিলেন দীনেশ। লাউ গাছ উঠেছে দেওয়াল বেয়ে। এক পড়শি বলেন, “নিজেই কুয়ো খুঁড়ে চাষবাস শুরু করেন। সকালে ২০০ ও ৫০০ গ্রামের প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিজের খেতের ঢেঁড়শ-করলা বিক্রিও করতেন।”
এ দিন আদালতে বিক্রমের কাছে ওই বাড়িটি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি কিছু বলেননি। তাঁর আইনজীবী বলেন, “এই মর্মে আমারও কিছু জানা নেই।” |