জমি জট
চাষিদের থেকে সরাসরি জমি কিনতে নেমে দ্বিধায় এনটিপিসি
মতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নীতি মেনে কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য সরাসরি জমি কিনতে এগিয়েছিল জাতীয় তাপবিদ্যুৎ নিগম (এনটিপিসি)। কিন্তু চাষিদের থেকে একলপ্তে ৫০০ একর জমি কেনা আদৌ সম্ভব, না কি সিঙ্গুরের মতো এখানেও ‘ইচ্ছুক’ ও ‘অনিচ্ছুক’ দুই পক্ষ তৈরি হয়ে কাজ ভেস্তে যাবে, কেন্দ্রীয় সংস্থাটি তা নিয়ে ঘোর সংশয়ে।
বর্ধমানের কাটোয়ায় এই ১৬০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ার জন্য মোট জমির ৫৫৬ একর আগেই অধিগ্রহণ করেছিল পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার। সরকারকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে সেই জমি হাতে নেওয়ার কথা এনটিপিসি-র। কিন্তু সংশয় রয়েছে বলেই এখনও টাকা দেওয়া হয়নি, এমন দাবি সংস্থার কর্তাদের একাংশের। প্রকল্পের প্রয়োজনে বর্ধমান-কাটোয়া ব্রডগেজ লাইন পাততে রেল যে টাকা চেয়েছে, তা নিয়েও উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না।
সংশয়ের প্রধান কারণ, কাটোয়ার কোশিগ্রাম, শ্রীখণ্ড ও জাজিগ্রাম মৌজায় যে শ’পাঁচেক একর জমি কেনার কথা ভাবা হচ্ছে, তা ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় চার হাজার মালিকের হাতে। যাঁদের সামান্য অংশ বেঁকে বসলেই গোটা প্রকল্প ভেস্তে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে, কোটি কোটি টাকার লগ্নিও জলে যাবে। কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার রামানুজ মিশ্রের কথায়, “কিছু জমি হাতে পাওয়ার বিষয়ে সংশয় রয়েছে।” এর আগে সিঙ্গুরে জমি-মালিকদের একাংশ জমি দিতে বেঁকে বসায় মোটরগাড়ি কারখানা গুটিয়ে নিতে হয়েছে টাটাদের। সে কারণে, ‘সরকারি ভাবে’ জমি কেনার প্রস্তাব দেওয়ার আগে প্রত্যেক মালিকের কাছ থেকে লিখিত ‘আশ্বাস’ও নিতে চাইছেন সংস্থার কর্তারা।
বস্তুত, এর আগে এনটিপিসি দেশ জুড়ে যে ২৮টি প্রকল্প গড়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার জমি অধিগ্রহণ করে দিয়েছে। প্রকল্পের এক আধিকারিকের কথায়, “সরাসরি জমি কিনে প্রকল্প গড়ার চেষ্টা এই প্রথম। এখানে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা লগ্নি করতে হবে।” রামানুজবাবু বলেন, “আমরা ঠিক করেছি, প্রত্যেক জমি-মালিকের থেকে লিখিত আশ্বাস চাইব।” যদিও ‘আশ্বাস’ দেওয়া মানেই চাষি জমি দিতে বাধ্য নন। পরে দরদাম বা অন্য শর্তে না পোষালে তিনি পিছিয়ে যেতেই পারেন।
জমি-মালিকদের বড় অংশই কিন্তু মনে করছেন, এই ‘আশ্বাস’ চাওয়ার আগে এনটিপিসি-র প্রস্তাবিত দর জানানো উচিত। রাজ্য মন্ত্রিসভা প্রকল্প গড়ার ‘ছাড়পত্র’ দিয়েছে, তা-ও তিন মাস হয়ে গেল। রাজ্য সরকার ভূমি সংস্কার আইনের ১৪ওয়াই ধারায় জমি কেনার ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করলেই যাতে চাষিদের সরাসরি প্রস্তাব দেওয়া যায়, তার জন্য তৈরি থাকা উচিত এনটিপিসি-র।
জমি অধিগ্রহণ পর্বে গড়ে ওঠা ‘কৃষি, কৃষক ও খেতমজুর বাঁচাও কমিটি’র (এখন বিলুপ্ত) নেতা দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ওঁদের বলেছি, চাষিরা জমি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আগে ন্যায্য দর জানিয়ে তার পরে জমি কিনতে নামতে হবে।”
কী দরে জমি কিনবে এনটিপিসি?
এনটিপিসি সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে যে দামে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তা সরকারি নিয়মে বেড়ে এখন যা হওয়া উচিত, সেটাই দর হিসেবে গণ্য হতে পারে। তবে মৌজা অনুযায়ী দামের হেরফের হবে। জমির দামের সঙ্গে যোগ হবে ৩০ শতাংশ ‘ক্ষতিপূরণ’। দফায়-দফায় কথাবার্তার সময়ে জমি-মালিকদের ঠারেঠোরে তা জানানোও হয়েছে। কিন্তু সরকারি ভাবে এখনও কিছু জানানো হয়নি। কয়েক দিন আগে জাজিগ্রামের কদমপুকুরে এনটিপিসি-র লোকেরা জমি পরীক্ষা করতে গেলে জমির দর জানতে চেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁদের বাধাও দেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মতে, ন্যায্য দর পেলে কোনও চাষিই জমি দিতে পিছপা হবেন না। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অচিন্ত্য মল্লিক বলেন, “কাটোয়ার চাষিরা আগেই এই প্রকল্পে জমি দিয়েছেন। এখনও দিতে চান। সিঙ্গুরের পরিণতি দেখে ওঁরা আরও বেশি করে বুঝেছেন, বাস্তবটা কী।”
তৃণমূলের বর্ধমান জেলা সহ-সভাপতি কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “জমি নিয়ে এই দ্বিধার কোনও মানেই হয় না।” শ্রীখণ্ড পঞ্চায়েতের প্রধান তথা কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক দীপক মজুমদারের টিপ্পনি, “চাষিরা জমি দিতে চাইছেন। কিন্তু এনটিপিসি যে কী চাইছে, সেটাই পরিষ্কার নয়!”
সরকারি ভাবে জমির দর জানানো হচ্ছে না কেন?
এনটিপিসি সূত্রের দাবি, দর জানিয়ে জমি-মালিকদের প্রস্তাব দেওয়ার অর্থ কার্যত জমি কিনতে নেমেই পড়া। সে ক্ষেত্রে আগে তাদের টাকা মিটিয়ে অধিগৃহীত জমি হাতে নেওয়ার জন্য চাপ বাড়াতে পারে রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল)। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রথমে তাদেরই গড়ার কথা ছিল। সে কারণে জমি অধিগ্রহণ করে তাদের হাতেই তুলে দিয়েছিল রাজ্যের ভূমি দফতর। এখন ওই জমির দাম ও পরিকাঠামো বাবদ ১০১ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা পিডিসিএল-কে মিটিয়ে দেওয়ার কথা এনটিপিসি-র। সংস্থার এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর (পূর্বাঞ্চল-১) উমেশপ্রসাদ পানি বলেন, “ওই টাকা দেওয়ার জন্য বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এর অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। এখনও তা মেলেনি।”
বস্তুত দু’পক্ষই এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছে। দুই সংস্থাই চাইছে, অন্য পক্ষ আগে হাত বাড়াক। এর একটা কারণ যদি সিঙ্গুরের তিক্ত অভিজ্ঞতা, অন্যটা অবশ্যই রাজ্য সরকারের শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করার নীতি।
জমি অধিগ্রহণের নীতি থেকে রাজ্য সরকার সরে এলে এই সঙ্কট যে তৈরি হতে পারে, তা কিন্তু বণিকমহল আগেই আঁচ করেছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনে ভর করে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই মমতা জানিয়ে দেন, সরকার শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না। শিল্প সংস্থাকেই জমি কিনে নিতে হবে। যে রাজ্যে সিংহভাগ জমি ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের হাতে ছড়িয়ে রয়েছে, সেখানে এই সরাসরি জমি কেনার নীতি কতটা বাস্তবসম্মত হবে, তা নিয়ে গোড়াতেই প্রশ্ন তুলেছিল শিল্পমহল। জমির জটে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে জয় বালাজি, বর্ধমানের জামুড়িয়ায় ভিডিওকন, সালানপুরে ভূষণ স্টিলের মতো বেশ কিছু প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এক মাত্র এনটিপিসি-ই নিজেরা জমি কিনতে এগিয়েছে।
কিন্তু তারাও যে সংশয়ে ভুগছে, সেটা স্পষ্ট।
চাষিদের মনোভাব বুঝতে সম্প্রতি নয়াদিল্লি থেকে কাটোয়ায় আসেন এনটিপিসি-র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশন) নীরজ কপূর। প্রকল্পের অতিরিক্ত জেনারেল ম্যানেজার শিবাশিস বসুকে নিয়ে জাজিগ্রামে গিয়ে জমি-মালিকদের সঙ্গে কথাও বলেন। তাঁরা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক এনটিপিসি কর্তা বলেন, “কেউই সরাসরি বলেননি যে জমি দেবেন না। কিন্তু আগে থেকে লিখিত আশ্বাস পাওয়া গেলে তবেই ইচ্ছুক জমিদাতার সংখ্যা বোঝা যাবে।” তাঁদের ধারণা, কয়েক জন যদি প্রথমে ‘অনিচ্ছুক’ থেকেও যান, সিংহভাগ ‘ইচ্ছুক’ চাষির চাপে তাঁরাও ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ জমি দিতে রাজি হয়ে যাবেন।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক অমল হালদারের কটাক্ষ, “তৃণমূলের জমি-নীতি শিল্পোদ্যোগীদের জন্য কী ভয়ের আবহ তৈরি করেছে, এনটিপিসি-র সংশয়েই তা পরিষ্কার। চাষিরা জমি দিতে চাইছেন। কিন্তু শিল্পসংস্থা তাতে ভরসা রাখতে পারছে না। আবার সরকারও জমি পেতে সাহায্য করছে না। এ রাজ্যে শিল্প হবে কী করে?”
এনটিপিসি শেষমেশ তীরে তরী ভেড়াতে পারে, না কি সিঙ্গুর বৃত্তান্তের পুনরাবৃত্তি হয় সব মহলই আপাতত তা দেখার অপেক্ষায়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.