কন্যাভ্রূণ হত্যার যে বিপুল ব্যাধি সমাজকে গ্রাস করিয়াছে, তাহার প্রতিকার করিতে অন্ধকারে তির ছুড়িতেছে সরকার। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক রেডিয়োলজিস্ট চিকিৎসকদের কর্মস্থল এবং কাজের সময় সীমিত করিয়া তাহাদের উপর নিয়ন্ত্রণ আনিতে চাহিয়াছে। ইহার প্রাণপণ বিরোধিতা করিতেছেন চিকিৎসকরা, যদিও কন্যাভ্রূণ হত্যার সমস্যার কোনও সমাধান করিতে তাঁহারা উৎসাহী নহেন। এই পরিস্থিতিতে কাহাকে ছাড়িয়া কাহার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করা উচিত, তাহা নির্ধারণ করাই দুঃসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে। প্রতিটি জনগণনায় শিশুকন্যাদের অনুপাত যেমন দ্রুত হারে কমিতেছে, তাহাতে আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তির প্রয়োগ করিয়া গর্ভের শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ হইতেছে এবং কন্যা হইলে গর্ভপাত ঘটিতেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। আলট্রাসাউন্ড যন্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন করা হইয়াছে, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলির উপরেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হইয়াছে। কিন্তু আইন রহিয়া গিয়াছে খাতায়-কলমে। বাস্তবে নজরদারি এবং শাস্তি প্রদানের কোনও প্রক্রিয়াই কার্যকর করা হয় নাই। নিতান্ত লোক দেখাইতে মাঝে মাঝে দু-একটি প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি হইয়া থাকে, কয়েকটি যন্ত্র বাজেয়াপ্ত হয়। কিন্তু তাহা যে সিন্ধুতে বিন্দুও নহে, তাহার প্রমাণ ভূরি ভূরি। অকাতরে এই অপরাধ চালাইতে কোনও অসুবিধাই হইতেছে না চিকিৎসকদের। সম্ভবত রেডিয়োলজিস্টদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করিবার সরকারি প্রয়াস এই কারণেই। দুটির বেশি প্রতিষ্ঠানের সহিত যুক্ত হইতে পারিবেন না একজন রেডিয়োলজিস্ট, এবং কোথায় কে কাজ করিতেছেন তাহা নথিবদ্ধ করিতে হইবে, এমন নিয়ম করিয়া নজরদারির সুবিধা করিবার, এবং প্রতিষ্ঠানগুলিকেও দায়বদ্ধ করিবার একটি উদ্যোগ লইতে চাহিয়াছে মন্ত্রক। এই প্রয়াসের পশ্চাতে যুক্তিটি ভ্রান্ত নহে, কিন্তু পদ্ধতিটি ভুল। আলট্রাসাউন্ড কেবল কন্যাভ্রূণ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার হয় না, কেবল গর্ভবতীদের জন্যও নহে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইহার প্রয়োগ অনেক, এবং তাহাতে রোগ নির্ণয়ের সুবিধা হয়। বহু রোগী এর ফলে প্রাণে বাঁচিয়া যান। রেডিয়োলজিস্টের কাজের পরিধি কমাইলে যন্ত্রের ব্যবহারও কমিবে, তাহাতে জনস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব পড়িতে বাধ্য।
চিকিৎসকরা ইহাও আপত্তি করিয়াছেন যে, প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করিতে হইলে তুলনায় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলিই রেডিয়োলজিস্টরা ছাড়িয়া দিবেন। তাহা হইলে দরিদ্র রোগীই বঞ্চিত হইবেন বেশি। এই যুক্তিও অগ্রাহ্য করিবার নহে। ভারতে চিকিৎসক অপ্রতুল, প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অতি সামান্য। যেখানে চিকিৎসকের অভাব, সেখানে চিকিৎসকদের কাজের পরিধি কমাইলে সংকট বাড়িবে। কিন্তু সরকারের প্রচেষ্টার সমালোচনা ও বিরোধিতা করিয়াই চিকিৎসকদের সংগঠনগুলি কাজ সারিতে পারে না। বরং যথার্থ নিয়ন্ত্রণের পন্থা কী কী হইবে, নজরদারি ঠিক মতো হইতেছে কি না, কাহাদের দোষে ফাঁক থাকিয়া যাইতেছে, এই বিষয়ে সংগঠনগুলি সরকারকে পরামর্শ দিবে, পথ দেখাইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। সংগঠনই সদস্যদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ রাখিবে না কেন? দুঃখের বিষয়, এ দেশে স্ত্রীরোগ এবং রেডিয়োলজি, এই দুটি চিকিৎসা বিভাগের চিকিৎসক সংগঠনগুলি কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রতিরোধের জন্য কিছু লোক-দেখাইবার আলোচনা সভা ভিন্ন কিছুই করে নাই। সংগঠনগুলি নিজেদের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করিবার জন্য কোনও তাৎপর্যপূর্ণ কর্মসূচি নেয় নাই, আবার সরকারি নিয়ন্ত্রণেরও বিরোধিতা করিয়াছে। সামাজিক ন্যায় এবং রাষ্ট্রের কল্যাণের প্রতি ইহারা সম্পূর্ণ উদাসীন। স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং চিকিৎসক সংগঠন, কেহই তাই সমর্থনযোগ্য নহে। |