আরও এক বার জন-অরণ্যে শ্বাসরুদ্ধ হইল মহানগর। অর্থাৎ, আরও একটি একুশে জুলাই পার হইল। ১৯৯৩ সালে এই দিনটিতে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পুলিশের গুলিচালনায় তেরোটি প্রাণহানি ঘটিয়াছিল। ঘটনাটি অতীব পরিতাপজনক। অতঃপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতি বৎসর সেই মৃত্যুর স্মরণে উক্ত দিবসটি পালন করিয়া থাকেন। পালনকর্মটি সূচনার সময় তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয় নাই। মমতাও কংগ্রেসকর্মী ছিলেন। অতঃপর, তৃণমূলের জন্ম, উত্থান-পতন, অবশেষে পরিবর্তন-এর মন্ত্র-সহ পশ্চিমবঙ্গে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ। সেই দিবসটি এক্ষণে তৃণমূল কর্মীদের বিপুল সমাবেশে পরিণত। শোকের আবহটি বিদ্যমান, কিন্তু দিনটির তাৎপর্য বদলাইয়া গিয়াছে। এক্ষণে দলীয় কর্মী-সমর্থকদিগের সংগঠিত এবং উদ্দীপিত করিবার জন্য দিবসটি পালিত হয়। রুদ্ধদ্বার কক্ষে বা প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠানটি ঘটিলে বলিবার কিছু থাকিত না। অথচ, উৎসবের খাতিরে একটি দিনের জন্য কলিকাতা অবরুদ্ধ হইয়া পড়িল। বেশ কয়েক বৎসরই এমন চলিতেছে। মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র ধমর্তলাগামী রাস্তাগুলি সমাগত তৃণমূল কর্মীদের দখলে। জনজীবন স্তব্ধ। পুলিশ অসহায়। সংশয় জাগে, প্রশাসনই বকলমে এই দিবস-উদযাপনে যোগ দেয় নাই তো?
দল এবং সরকার এক নহে। পার্থক্যটি বজায় রাখা জরুরি। গণতন্ত্রের স্বার্থেই জরুরি। কোনও দল বিশেষ কোনও সময় একক বা জোটভুক্ত ভাবে ক্ষমতায় থাকিতেই পারে। তাই বলিয়া সেই দল সরকারের সহিত প্রশাসনিক অর্থে সমার্থক হইয়া যায় না। নেতা বা নেত্রী যখন প্রশাসকের আসনে, তখন তিনি নির্দিষ্ট কোনও দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। সুতরাং, নিজস্ব বক্তব্য পেশ, কর্মীদের উৎসাহদান বা কর্মসূচি ঘোষণার জন্য মহানগরীকে কার্যত পণবন্দি করা অনুচিত। নীতিগত ভাবেই অনুচিত। প্রশাসন নিজস্ব কর্মে শহরের কোনও এলাকা বন্ধ রাখিয়া নাগরিক পরিষেবা সাময়িক ভাবে ব্যাহত করিতে পারে। কারণ, তাহা জনস্বার্থে কৃত। ধর্মতলার মোড়ে একুশে জুলাই পালনের সহিত জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নাই। ইহা চরিত্রগত ভাবেই একটি বাৎসরিক দলীয় কর্মকাণ্ড। তাহার জন্য কলিকাতাকে দখল করিবার কারণ কী? আর, যদি সারিবদ্ধ গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি নিশ্চল করিয়া ‘ঐতিহাসিক’ মিছিলের আয়োজন হয়, তাহা হইলে ‘পরিবর্তন’ কী-ই বা হইল?
ইতিহাস বলিবে, এমন সংগঠিত ভাবে সরকারি প্রশ্রয়ে নগর অচল করিবার পালা বিগত বাম জমানায় শুরু। ব্রিগেড সমাবেশ তো বটেই, নানা সময় মিছিলেও মহানগরী একাধিক বার পণবন্দি হইয়াছে। কাহারও কিছু বলিবার নাই। ক্যাডারগণ দাপাইয়া বেড়াইতেছেন। পুলিশ পথিমধ্যে অসহায় এবং সলজ্জ বদনে দৃশ্যমান, কখনও বা অদৃশ্য। কর্মক্লান্ত জনতা তো বটেই, শিশু, নারী এবং বয়স্কেরাও করুণ ভাবে রাস্তায় প্রহর গনিতেছেন। গণতন্ত্রের আড়ালে দলতন্ত্র চলিতেছে। নূতন সরকার ক্ষমতায় আসিবার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলতন্ত্রের আস্ফালনে ভুক্তভোগী জনতাকে কিছু মৌলিক পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়াছিলেন। ক্ষমতাসীন হইবার পরে দ্বিতীয় একুশে জুলাই প্রমাণ করিল, অন্তত এই ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে নাই। শোভাযাত্রা, লোকারণ্য মহা ধুমধাম পূর্বাপর বিদ্যমান। শুধু পতাকার রংটি বদলাইয়া গিয়াছে। বার্তাটি ইতিবাচক নহে। কর্মনাশা বলিয়া তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী বন্ধ সমর্থন করেন না। ইহা সাধুবাদের যোগ্য। একই যুক্তিতে কলিকাতাকে এই রূপে অচল করাও পরিত্যজ্য। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাহা স্মরণে রাখিলে পশ্চিমবঙ্গেরই মঙ্গল। |