দেশের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আর তাঁর হাত ধরে বাঙালিও আজ পৌঁছে গেল রাইসিনা পাহাড়ের শৃঙ্গে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে ছ’দশকেরও প্রাচীন সংসদীয় ব্যবস্থায় এই প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেবেন কোনও বঙ্গসন্তান!
ইতিহাস তো বটেই। তবু কার্যত সবটাই যেন প্রত্যাশিত ছিল। আজ যা হল, তা ভোট গণনার পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফলাফল ঘোষণা ও জয়ের উৎসব উদ্যাপন। সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে উত্তেজনাময় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণব মুখোপাধ্যায় জিতলেন ৬৯.৩১% ভোট পেয়ে। মোট প্রদত্ত ১০২৯৯২৪টি ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৭১৩৯৩৭টি।
নিছক এই সংখ্যাতত্ত্বকে পাশে সরিয়ে রাখলে বাকি রহস্যভেদ আসলে হয়ে গিয়েছিল এক মাস আগে। যে দিন ইউপিএ-র বৈঠক ডেকে সনিয়া গাঁধী জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণবই শাসকজোটের প্রার্থী। ইতিহাস রচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল সে দিনই। রাজনীতির চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এত দিনে বীরভূমের খর্বকায় ব্রাহ্মণসন্তানটি দেশের ‘ফার্স্ট সিটিজেন’ হতে চলেছেন। ফল প্রকাশের পরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, ইউপিএ সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতা রাহুল গাঁধী তাই তাঁর বাড়ি বয়ে এলেন অভিনন্দন জানাতে।
এমন একটা দিনে প্রণববাবু স্বয়ং কী করলেন?
যা-ই হোক না কেন, তিনি তো প্রণব মুখোপাধ্যায়ই! যাঁকে আজ বেলা বারোটাতেও কেউ অভিনন্দন জানাতে গেলে বলেছেন, “ধন্যবাদ! কিন্তু আগে গণনা শেষ হোক।” নিশ্চিত জয়ের মুখে দাঁড়িয়েও তাঁর এই সংযত প্রতিক্রিয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই সামনের মানুষটির মনে বিস্ময় জেগেছে। এবং তা নিয়ে ফের প্রশ্ন করলে তিনি স্মিত হেসে বলেছেন, “আমি তো বুকিশ।’’ বাবার এই প্রতিক্রিয়া দেখে মেয়ে শর্মিষ্ঠা বলেছেন, “মানুষটা তো আর বদলে যাননি।”
সকালে বিরোধী শিবির থেকে তাঁর কাছে প্রথম ফোনটি আসে লোকসভায় বিজেপি’র প্রাক্তন উপ-নেতা বিজয় মলহোত্রের। তার পরে অগুন্তি। দু’টো মোবাইল ফোনে লাগাতার অভিনন্দনবার্তা সামলাতে সামলাতে প্রণববাবু বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত সংখ্যার হিসেব কষে গিয়েছেন। আর ফাকে-ফাঁকে ফিরে গিয়েছেন অতীতে। তার মধ্যেই যখন খবর এসেছে যে প্রতিদ্বন্দ্বী পূর্ণ সাংমার ঘাঁটি মেঘালয়-সহ গোটা উত্তর-পূর্বেই তিনি বেশি ভোট পেয়েছেন, তখন কিছুটা যেন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন প্রণব। |
বৈধ ভোট
১০, ২৯, ৭৫০ |
|
প্রণব পেয়েছেন
৭,১৩,৭৬৩ |
সাংমা পেয়েছেন
৩,১৫,৯৮৭ |
|
২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি পদে প্রণববাবুর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য ‘ড্রেস রিহার্সাল’ শুরু হয়ে গিয়েছে। আজ বিকেলে রাষ্ট্রপতি ভবনের সচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব এসে তাঁকে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন সমস্ত খুঁটিনাটি। শর্মিষ্ঠা রাষ্ট্রপতি ভবনের অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করে বুঝে নিয়েছেন প্রাসাদের ‘লে আউট’ কোন ঘরটায় প্রণববাবু থাকবেন, কোথায় রাখা হবে তাঁর বিপুল বইয়ের সম্ভার।
তবে এ সবই সরকারি বন্দোবস্ত। মানসিক ভাবে এই দিনটার কত ‘মহড়া’ দিয়েছে মুখোপাধ্যায় পরিবার, তার ইয়ত্তা নেই।
এবং প্রণববাবুর স্মৃতিচারণাতেও আজ বারবার উঠে এসেছে পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ যাত্রাপথের কথা। বাংলা কংগ্রেসের সংবিধান রচনা থেকে শুরু করে প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠার মাঝে নানান ঘটনা নিয়ে ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের অন্দরমহলে আজ দৃশ্যতই স্মৃতির কোলাজ। আবেগ চেপে রাখেননি স্ত্রী শুভ্রা। বলেছেন, “জানেন তো, ছোট বেলায় এক পুরোহিত আমাকে দেখে বলেছিলেন, এই মেয়ের রাজরানি হওয়ার যোগ রয়েছে। সেটা এমন ভাবে সত্যি হয়ে যাবে...!” পাঁচ বছরের নাতনি আহানা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। তবু দাদুর যে আজ আনন্দের দিন, তা ঠাহর করতে অসুবিধে হয়নি। দাদুকে গলা জড়িয়ে আদর করেছে সে।
প্রণববাবু নিজে সংযত থাকলেও তাঁর বাড়ির বাইরে অবশ্য আনন্দ-উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল সাতসকালেই। গেটের বাইরে উদ্দাম কাড়া-নাকাড়া-তাসা-ব্যান্ডের সঙ্গে বিলি হয়েছে হরেক কিসিমের মিষ্টি। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ প্রণববাবুর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা মোট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেক পেরিয়ে যাওয়ার পরে আতসবাজি উড়েছে আকাশে। দুপুরে কালীবাড়ি থেকে আসা খিচুড়ি প্রসাদ খেয়ে তা দেখতে এক বারই জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়েছিলেন প্রণববাবু। বললেন, “বাবা, ওঁদের দেখছি ভীষণ আনন্দ!”
তবে ওইটুকুই। অফিসঘর থেকে বাড়ির উঠোনে বেরিয়েছেন সেই বিকেল পাঁচটার পরে। তা-ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে অভ্যর্থনা জানাতে। যিনি সস্ত্রীক দেখা করতে আসার আগে ফোনে বলেছেন, “মি: প্রেসিডেন্ট!” আর বাড়িতে দেখা করতে এসে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সরস মন্তব্য, “আপনাকে তো এখন থেকে মহামহিম বলে ডাকব!” বাড়ির সকলের সঙ্গে বসে খোশগল্পে মেতেছেন সনিয়া-মনমোহন-রাহুল। তাঁদের বিদায় জানাতে আবার গেট পর্যন্ত এসেছেন প্রণববাবু। এবং আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পরে। গেটের বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ের জন্য এই মহান দেশের সব নাগরিককে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাঁদের এত দিন যা দিতে পেরেছি, তার অনেক বেশি ওঁরা আমায় দিয়েছেন।”
১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের চেহারাটাও যেন বদলে গিয়েছে রাতারাতি। সনিয়া-মনমোহন আসবেন বলে দুপুর থেকে প্রণববাবুর বাড়ি চলে নিয়েছিল এসপিজি-র ঘেরাটোপে। ফল ঘোষণার পরে সুরক্ষার ভার নেয় সেনাবাহিনী। এর মাঝে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম-সহ শীর্ষ মন্ত্রীরা ভাবী রাষ্ট্রপতিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানান মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া।
প্রণববাবু নিজে বিকেল থেকে শরিক-সমর্থক দলের নেতাদের ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রথম ফোনটি করেন দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক বন্ধু, তথা ডিএমকে প্রধান করুণানিধিকে। সন্ধ্যায় বৈঠকে বসেন উপদেষ্টা ও সহায়কদের সঙ্গে। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর: ভোটাভুটির চাপ কেটে গেলেও তাঁর মাথায় এখন অন্য চিন্তা। আগামী বুধবার সংসদের সেন্ট্রাল হলে তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে শপথ নেবেন, দেবেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা। সেই বক্তৃতায় কী বলবেন, তা নিয়ে এখনই মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি যে আপাদমস্তক ‘বুকিশ!’ |