মধুরেণ সমাপয়েৎ!
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই নিয়ে দু’জনের সম্পর্কে যে কালো মেঘের সঞ্চার হয়েছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থনের কথা ঘোষণা করায় তা খানিকটা কেটে গিয়েছিল। কিন্তু আজ বিকেলে প্রণববাবু যখন তাঁকে ফোন করে বললেন, ‘শপথ অনুষ্ঠানে তোকে থাকতেই হবে’, অভিভূত হয়ে পড়লেন মমতা। জানিয়ে দিলেন যাবেন, নিশ্চয়ই যাবেন। আর তখনই যেন সব মেঘ সরে গেল এক মুহূর্তে। ফিকে হয়ে যাওয়া দু’জনের সম্পর্ক যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল।
বিকেলে ভোট গণনা তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু অর্ধেকের বেশি ভোট পেয়ে যাওয়ায় প্রণববাবুর রাইসিনায় যাওয়া নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। ঠিক সেই সময়েই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন ভাবী রাষ্ট্রপতির। মমতা এ প্রান্ত থেকে সাড়া দেওয়া মাত্র প্রণববাবু সোজা-সাপ্টা বলেন, “শোন, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, তুই কিছু মনে রাখিস না, আমিও মনে রাখব না। কিন্তু বুধবার তুই যদি না আসিস, আমার শপথ গ্রহণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।” মমতা কিছু বলতে গেলেও প্রণববাবু বলে চলেন, “তোর অসুবিধা থাকলে বিশেষ বিমান তোকে কলকাতা থেকে নিয়ে আসবে। অনুষ্ঠান শেষে আবার কলকাতা পৌঁছে দেবে। তুই কিন্তু না বলিস না।”
কাল ২১ জুলাইয়ের বিশাল জনসভার সাফল্যে আজ স্বাভাবিক ভাবেই খুশির মেজাজে ছিলেন মমতা। কালই তিনি ঘোষণা করেছেন, সম্মান পেলে ইউপিএ ছাড়ার কোনও ইচ্ছা তাঁর নেই। তার পরে আজ বিকেলেই প্রণববাবুর এই ফোন। মমতা তাঁকে বলেন, “আপনি আমার শ্রদ্ধেয়। গুরুজন। মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কে তার কোনও ছাপ পড়ুক, তা আমি কখনওই চাই না। আমি আজও আপনাকে আগের মতোই শ্রদ্ধা করি। আপনি চেয়েছেন, আমি অবশ্যই যাব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।” মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গল ও বুধবার, দু’দিনই তাঁর ঠাসা কর্মসূচি ছিল। কিন্তু তা পরিবর্তন করে মঙ্গলবার দিল্লি যাচ্ছেন মমতা। বুধবার প্রণববাবুর শপথে যোগ দিয়ে সে দিনই তিনি কলকাতা ফিরতে চান।
বাংলার দুই শীর্ষ রাজনীতিক মমতা ও প্রণবের সম্পর্ক যেন ‘কখনও রোদ, কখনও ছায়া’। এক বছর আগে রেলমন্ত্রী থাকার সময়েও প্রণববাবুর বাড়িতে ছিল মমতার নিত্য যাতায়াত। মমতা ব্যাগ খুলে প্রণবের হাতে চকোলেট দিয়ে বলতেন, “খেয়ে ফেলুন।” বেশ ডায়াবেটিস প্রণববাবুর, মিষ্টি খাওয়া বারণ। কিন্তু দিব্যি খেয়ে নিতেন সেই চকোলেট। কেউ প্রশ্ন করলে বলতেন, “মমতা কিছু বললে তো ফেলা যায় না!” আর পাঁচ জনের কাছে মমতার প্রশংসায় প্রণববাবুও বরাবর ছিলেন পঞ্চমুখ। বলতেন, “ওর জনপ্রিয়তা আমাদের অনেকের চেয়েই অনেক বেশি। কংগ্রেস ছেড়ে তো অনেকেই বেরিয়েছে। কিন্তু কেউই প্রায় কিছু করে উঠতে পারেননি। মমতা কিন্তু করে দেখিয়েছে।”
সেই মমতার সঙ্গে প্রণববাবুর ‘ছায়ার সম্পর্ক’ শুরু নিছক ‘দেনা-পাওনা’ নিয়ে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কিছু আর্থিক সুবিধা চেয়ে কেন্দ্রের কাছে দরবার করেন। কিন্তু তেমন কোনও সাড়া পাননি। ঘনিষ্ঠদের মতে, প্রণববাবু চেষ্টা করেও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাধ্যবাধকতার বরফ গলাতে পারেননি। মমতা এর জন্য অর্থমন্ত্রী প্রণববাবুকেই দায়ী করেন। দু’জনের বাক্যালাপও এক রকম বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে প্রণববাবুরও নিশ্চয়ই অভিমান ছিল। তাই কংগ্রেসের অনেক নেতা যখন বারে বারে তাঁকে মমতাকে ফোন করে সমর্থন চাওয়ার কথা বলেন, প্রণববাবু এড়িয়ে যান। ঘনিষ্ঠ মহলে বলেন, “ও আগে সমর্থনের একটা ইঙ্গিতও দিক, আমি ঠিক ফোন করব।” মমতা সমর্থনের কথা ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে ফোন করেন প্রণববাবু। বলেন, “অজস্র ধন্যবাদ। তুই পাশে না দাঁড়ালে আমার জয় অসম্পূর্ণ থেকে যেত।” আসলে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী তাঁকে সমর্থন ঢেলে দিলেও নিজের রাজ্য থেকে অন্যরকম বার্তা আসায় অস্বস্তি কাটছিল না ভাবী রাষ্ট্রপতির। মমতা সমর্থন জানানোয় স্বস্তি ফিরে পান তিনি।
জয়ের পরে প্রণববাবু আর ইউপিএ-র রইলেন না, কংগ্রেসেরও নয়। বুধবার শপথের পরে তিনিই হবেন দেশের সাংবিধানিক প্রধান। কিন্তু আজকের ফোনের পরে তাঁর সঙ্গে মমতার সম্পর্কের বরফ যে গলল, তাতে কংগ্রেস নেতৃত্ব খুশি। কারণ শরিক হিসেবে মুলায়মের চেয়ে মমতা তাঁদের কাছে অনেক বেশি আস্থাভাজন। |