|
|
|
|
ওয়াকআউট কংগ্রেসেরও |
প্রস্তাবেই বিতর্ক, ধাক্কা খেল সর্বদলের প্রয়াস |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রাজ্যের ঋণের উপরে তিন বছরের জন্য সুদ স্থগিত রাখার (মোরাটোরিয়াম) আর্জি জানাতে দিল্লিতে সর্বদল দরবারের প্রয়াস অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল! সরকার ‘সহমত’ গড়ে তুলতে আদৌ ‘আন্তরিক’ নয় বলে অভিযোগ করে ওই প্রচেষ্টা থেকে সরে দাঁড়াল শরিক কংগ্রেস এবং বিরোধী বামফ্রন্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৩ মাসের জমানায় জোট সরকারের শরিক কংগ্রেস বৃহস্পতিবারই প্রথম বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করল। পরে যে পথে হাঁটল বিরোধী বামেরাও। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে যে ঘটনাকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ধরে কংগ্রেস-সিপিএমকে ‘এক বৃন্তে দু’টি কুসুম’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছে তৃণমূল শিবির থেকে।
সুদ স্থগিত, কয়লার রয়্যালটি এবং অনগ্রসর জেলার উন্নয়নের জন্য তহবিলের টাকা আদায় এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে রাজ্যের সব দলের তরফে আবেদন জানানোর জন্য এ দিন বিধানসভায় সরকারি ভাবে একটি প্রস্তাব আনেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সমস্যা দেখা দেয় তখনই। সর্বদল আবেদনের জন্য সচরাচর বিধানসভার কার্যবিধির ১৮৫ নম্বর ধারায় ‘বেসরকারি’ প্রস্তাব আনা হয়। কিন্তু পার্থবাবু ১৬৯ নং ধারায় সরকারি প্রস্তাব আনায় বামেদের তরফে আপত্তি ওঠে। একই সঙ্গে বিবাদ বাধে প্রস্তাবের বয়ান নিয়েও। সুদ স্থগিত রাখার দাবির সঙ্গে বামেরা যেমন তাদের পূর্ব ঘোষণামতোই একমত হয়নি, তেমনই কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তোলার প্রতিবাদে সরব হয় কংগ্রেসও। শরিক কংগ্রেসের দেওয়া সংশোধনী গৃহীত হয়নি, বামেদের দেওয়া ১৮৫ নং ধারায় বিকল্প প্রস্তাব (যার মূল সুরে সরকারের প্রস্তাবের সঙ্গে বিশেষ ফারাক নেই) প্রস্তাবও মানা হয়নি। এসইউসি-র একমাত্র বিধায়ক তরুণ নস্কর অবশ্য সরকারের প্রস্তাবের মর্মার্থ সমর্থন করেছেন।
এর পরেও ‘রাজ্যের স্বার্থে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে কেন্দ্রের কাছে দরবার করতে যাওয়ার জন্য কংগ্রেস ও বামেদের প্রতি আর্জি অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন পার্থবাবু। কিন্তু সরকারের প্রস্তাবের বয়ান একই থাকলে তারা দিল্লি যাবে না বলেই জানিয়ে দিয়েছে দু’পক্ষই। কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাবের কথায়, “রাজ্যের উন্নয়নের জন্য ও রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট মোচনের জন্য দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দরবার করতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু এটা নিয়ে কেউ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুললে তা আমরা মেনে নিতে পারব না।” পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “দাবিগুলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটা সর্বসম্মত প্রস্তাব করাই যেত। কিন্তু সহমতের নমুনা তো দেখা যাচ্ছে! সরকারি প্রস্তাব আনা হচ্ছে, তাতে সংশোধনীর কোনও সুযোগ নেই। সংসদীয় রীতি-নীতি ভেঙে যা পারছেন, করছেন!” কংগ্রেস এবং বামেদের অনুপস্থিতিতে বিধানসভায় এ দিন পার্থবাবুর প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এর পরে তৃণমূল নিজেরাই (সঙ্গে এসইউসি) দিল্লিতে প্রতিনিধিদল পাঠাবে কি না, তা-ই দেখার।
ঘটনাচক্রে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম এ দিনই কলকাতায় এসে রাজ্যের আর্থিক দাবি সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এক দিকে ‘বিচক্ষণ’ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং অন্য দিকে ‘বাস্তববাদী’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই দু’জনের মিলিত প্রচেষ্টায় রাজ্যে উদ্ভূত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। চিদম্বরমের কথায়, “এটা আমার ব্যক্তিগত মত যে, এই রাজ্যের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। প্রচুর টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্যকে যৌথ ভাবে একটি সমাধান সূত্র বার করতে হবে।” এতে সময় লাগবে বলে মন্তব্য করে এবং প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর প্রসঙ্গ টেনে চিদম্বরম বলেন, “আমার বিশ্বাস তাঁরা দু’জনে কোনও না কোনও সমাধান সূত্র বার করে ফেলবেন।”
পরে অন্য একটি অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, পূর্ব ভারতে সবুজ বিপ্লবের খাতে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পশ্চিমবঙ্গকে সব চেয়ে বেশি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই খাতে ২৬৯ কোটি টাকা পাবে পশ্চিমবঙ্গ। তাঁর কথায়, “এ ছাড়াও, এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায় এবং সুসংহত উন্নয়ন প্রকল্প খাতে সমস্ত রাজ্যকে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে। ফলে এত টাকা ঠিক মতো খরচ করতে পারলে উপকৃত হবেন এই রাজ্যের মানুষ।”
বিধানসভায় একে ১৬৯ ধারায় সরকারি প্রস্তাব, তার উপরে তা নিয়ে আলোচনার জন্য কোনও সময় বরাদ্দ না-করেই প্রস্তাব এনে ফেলায় প্রবল বিতর্ক বাধে। সোহরাব সংশোধনী এনে বলেন, “প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও মোরাটোরিয়াম দেয়নি। এই ধরনের মন্তব্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত কুৎসা। এটা ঠিক নয়। বলা উচিত, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের এই নিয়ে বেশ কয়েক বার বৈঠক ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এখনও বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়নি। সমস্যা সমাধানে কেন্দ্র কমিটি পর্যন্ত গঠন করেছে।” সংশোধনী গৃহীত না-হওয়ায় কংগ্রেস বিধায়কেরা ওয়াকআউট করেন। জবাবি বক্তব্যে পার্থবাবু বলেন, “আবেদনের মূল সুরটা বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীই। যতটা গ্রহণ করা সম্ভব ছিল, এখানে করেছি। যখন আমরা সর্বদল প্রতিনিধিদল যাব, তখন সব কথাই সেখানে বলব। সেটা আলোচনাসাপেক্ষ। আজকের সিদ্ধান্ত হোক, আমরা যাচ্ছি।”
সোহরাবেরা রাজ্যকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আঙুল তুললে তাঁরা প্রতিবাদ করবেন। কংগ্রেসের আনা সংশোধনী নিয়ে ‘জটিলতা’ হচ্ছে জানতে পেরে এ দিন বিধানসভায় যান প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। পরিষদীয় দলনেতার সঙ্গে বৈঠকের পরে প্রদীপবাবু বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের প্রস্তাব কংগ্রেস সমর্থন করবে না। বিরোধিতা করবেই। কংগ্রেস পরিষদীয় দল তা-ই করেছে।” সরকারের দাবির মর্মার্থকে সমর্থন করলেও এসইউসি-র বিধায়ক তরুণ নস্করও বলেন, “এই প্রস্তাবটি যে ভাবে আনা হল, তা ঠিক নয়।” কংগ্রেস ও বামেদের জোড়া প্রতিবাদের বিষয়ে পরে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু কটাক্ষ করেন, “ভালই হল, লোকের যে ধারণা কংগ্রেস-সিপিএম এক বৃন্তে দু’টি কুসুম, সেটা নিজেরাই প্রমাণ করলেন! আমার বিশ্বাস, সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ওঁরা যাবেন।” পার্থবাবু এমন ‘বিশ্বাস’ রাখলেও দিল্লি আপাতত দূর অসৎ!
|
|
|
|
|
|