|
|
|
|
পরিষেবায় পিপিপি-সঙ্গী হতে নিয়ম বাঁধল রাজ্য |
রঞ্জন সেনগুপ্ত • কলকাতা |
নিজেরা ‘সহযোগীর’ ভূমিকায় থেকে পরিকাঠামো ও পরিষেবা উন্নয়নের প্রায় সব ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ চাইছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রকল্পে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে পিপিপি) উৎসাহ দিতে একটি সুসংহত নীতি বানিয়েছে রাজ্য। এবং তা অনুসরণ করে পিপিপি মডেলে প্রকল্প তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সরকারের বিভিন্ন দফতর ও সংস্থাকে।
নতুন নীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে মুখ্যসচিবের নামে জারি এক নির্দেশিকায় বলা হয়েছে: রাজ্য সরকার বিভিন্ন পরিকাঠামো-ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে। উন্নত ও কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নই সরকারের লক্ষ্য। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী সরকারি কোষাগারের টাকায় এই জাতীয় কাজ হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ‘বিকল্প বিনিয়োগে’ উৎসগুলোও পরিকাঠামো ও পরিষেবা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। যে কারণে বেসরকারি লগ্নিকে উৎসাহদানে পিপিপি-নীতি তৈরি
করেছে রাজ্য।
গত বছরের মে মাসে দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে পশ্চিমবঙ্গে। সুদ-আসল মিলিয়ে বছরে ২৫ হাজার কোটির কিস্তি মেটানোর দায় থাকায় সরকার যে গোড়া থেকেই ‘সংসার চালাতে’ হিমসিম খাচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তা জানিয়েছেন। কর্মীদের বেতন-পেনশন মিটিয়ে দৈনন্দিন ব্যয়ভার সামলে পরিকাঠামো ও পরিষেবা উন্নয়নে টাকা ঢালা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে রাজ্যের দাবি।
তাই সরকার গঠনের শুরু থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পিপিপি মডেলে’ জোর দিয়েছেন। কিন্তু দফতরগুলো যাতে নিজেদের মর্জিমাফিক পিপিপি-প্রকল্পে সামিল হতে না-পারে, সে জন্যই একটি সামগ্রিক নীতি প্রণয়ন করা হল বলে জানিয়েছেন সরকারের এক কর্তা। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “কেন্দ্রের পিপিপি-নীতির অনুকরণে রাজ্য এটি তৈরি করেছে।” উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী আগেই জানিয়েছেন, বেসরকারি প্রকল্পের মতো যৌথ উদ্যোগের ক্ষেত্রেও রাজ্য জমি অধিগ্রহণ করবে না। নতুন নীতিতেও প্রকারান্তরে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সরকারি-সূত্রে বলা হচ্ছে, পিপিপি-প্রকল্পের অংশীদারিত্বে রাজ্যের ভূমিকা হবে ‘সহযোগী’র। যেমন, প্রকল্প রূপায়ণে প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দেবে সরকার। কেন্দ্র ও রাজ্যের যাবতীয় সরকারি অনুমতি আদায়ের দায়িত্বও নেবে। কোনও প্রকল্পে পুনর্বাসনের দরকার পড়লে সরকারি নীতি মেনে তার ব্যবস্থা হবে। প্রকল্প এলাকায় জল-বিদ্যুতের জোগানও রাজ্যের দায়িত্ব। তবে যৌথ উদ্যোগ হলেও প্রকল্পের রূপরেখা থেকে অনুমোদন সবেতে সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কী রকম?
বলা হয়েছে, পিপিপি-প্রকল্পে চূড়ান্ত অনমোদন
দেবে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন সচিব পর্যায়ের ‘এমপাওয়ার্ড কমিটি।’ তার নীচে থাকবে অর্থ দফতরের অধীনস্থ পিপিপি সেল, যার মারফত দফতরগুলোর খসড়া প্রকল্প এমপাওয়ার্ড কমিটিতে পাঠানো হবে। কমিটিরও সীমাবদ্ধতা থাকছে। বিনিয়োগের অঙ্ক ৫০ কোটির বেশি হলে তা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার শিল্প ও পরিকাঠামো বিষয়ক সাব কমিটিতে পাঠাতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সাহায্যের স্বার্থে একটি তহবিল (পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন তহবিল) গড়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
নতুন নীতিতে পিপিপি-র তালিকায় রয়েছে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। যেমন স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পর্যটন, রাস্তা-সেতু-বাইপাস, বিমানবন্দর-এয়ারস্ট্রিপ-হেলিপ্যাড, শিল্পপার্ক-থিমপার্ক-নলেজপার্ক-উপনগরী-এসইজেড, শিল্প প্রশিক্ষণকেন্দ্র, পানীয় জল সরবরাহ ও জলশোধনকেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন-সংবহন-বণ্টন, কঠিন বর্জ্য, পয়ঃপ্রণালী ও নিকাশি, অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিবহণ, শহরের যান চলাচল এবং আবাসন। প্রয়োজনে এর বাইরেরও যে কোনও ক্ষেত্রকে পিপিপি-র আওতায় আনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এমপাওয়ার্ড কমিটিকে।
পিপিপি প্রকল্প রূপায়ণ হবে কোন পদ্ধতিতে?
এ ক্ষেত্রে রাজ্য নির্দিষ্ট কোনও একটা পদ্ধতি অনুসরণ করবে না। নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রতিটি প্রকল্পের গুরুত্ব বুঝে (কেস টু কেস) পদ্ধতি স্থির হবে। কোনও প্রকল্প হবে ‘বাই-বিল্ড-অপারেট’ ভিত্তিতে, কোনওটা হয়তো ‘বিল্ড-ওন-অপারেট’ নিয়মে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বিল্ড-ওন-অপারেট-ট্রান্সফার, বিল্ড-অপারেট-ট্রান্সফার কিংবা বিল্ড-লিজ-অপারেট-ট্রান্সফার পদ্ধতি মানা হবে। কাজ শুরুর আগে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে লিজ, অংশীদারিত্ব-সহ অন্তত ৯টি চুক্তি হবে সরকারের।
তবে সময় মেনে কাজ না-হলে বা শর্ত অমান্য হলে চুক্তি বাতিল হতে পারে।
কিন্তু নতুন নীতিতে পদ্ধতিগত জটিলতার ছায়াও দেখছে সরকারের একাংশ। কেন?
ওঁদের বক্তব্য: লগ্নিতে সরকারি জটিলতা এড়াতে বেসরকারি সংস্থার আবেদনপত্র ৯৩ থেকে ৭ পাতায় নামিয়ে আনা হয়েছে। ১৪ ওয়াই ধারায় ঊর্ধ্বসীমার বাড়তি জমি রাখার আবেদনে দু’সপ্তাহের মধ্যে মঞ্জুরি দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অথচ যে সব পদ্ধতি মেনে পিপিপি-প্রকল্প চূড়ান্ত করার কথা, তাতে অনেক সময় গড়িয়ে যাবে। বস্তুত পিপিপি-প্রকল্পে চূড়ান্ত অনুমোদনের পথেই বিস্তর জটিলতা রয়েছে বলে মনে করছে সরকারের ওই অংশ। যদিও সরকারের অন্য অংশের দাবি: নতুন নীতি মেনে এখনও কোনও প্রকল্প-প্রস্তাব তৈরি হয়নি। কাজেই বাস্তবে কতটা দেরি হচ্ছে, কী ধরনের বাধা আসছে, তা বলারও সময় আসেনি। তেমন হলে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন হতে পারে।
|
নীতি-কথা |
• গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো-পরিষেবায় পিপিপি |
• মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে ‘এমপাওয়ার্ড কমিটি’ |
• অর্থ দফতরের অধীনে ‘পিপিপি সেল’ |
• প্রকল্পে অর্থসাহায্যে তহবিল গড়া হবে |
•‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে পদ্ধতি নির্বাচন |
• শর্ত লঙ্ঘিত হলে চুক্তি বাতিলের সংস্থান |
|
|
|
|
|
|