একদা ‘প্রতি গ্রাসে মাছের মুড়ো’ চাইত বাঙালি। আর বাঙালি রসনার সেই চাহিদা মেটাত মৌরলা-পুঁটি-খয়রা-চাঁদা...। কিন্তু বাঙালির পাতে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া যাবে কি না, মৎস্যমন্ত্রী আবু হেনা সেই ব্যাপারে কোনও আশ্বাস দিতে পারছেন না। বৃহস্পতিবার বিধানসভায় ওই সব চুনো এবং বিভিন্ন ধরনের দেশি ছোট মাছ নিয়ে কোনও আশার কথাই শোনাতে পারেননি তিনি।
কোথায় গেল চুনো মাছ? মৎস্যমন্ত্রী জানান, নদীর দিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে চুনো মাছ কমে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলছে। কী ভাবে ওই সব মাছের উৎপাদন বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টাও করছে তাঁর দফতর।
কিন্তু বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশকর্মীদের বিচারে চুনো মাছের অন্তর্ধানের কারণ অন্য। তাঁরা মনে করেন, অনাবাদি জলাভূমি আর খালবিলের দ্রুত বিলুপ্তির জন্যই কুচো মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। কারণটা এতই স্পষ্ট যে, তার জন্য কোনও গবেষণার প্রয়োজন নেই। কয়েক বছর আগেও প্রচুর জলাভূমি ছিল, যেখানে সংগঠিত ভাবে মাছ চাষ হত না। সেই সব জলাভূমিই ছিল বিচিত্র চুনো ও দেশি ছোট মাছের আবাস। কিন্তু জলাভূমিগুলিতে রুই, কাতলা বা তেলাপিয়া মাছের একচেটিয়া চাষ শুরু হওয়ার পরে চুনো মাছের দিন গিয়েছে। ধানখেতেও প্রচুর চুনো মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু ধানজমিতে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় চুনো মাছের সঙ্কট বেড়েছে। সংস্কারের অভাবে খালবিল হয় মজে যাচ্ছে, নয়তো যাচ্ছে শুকিয়ে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে চুনো মাছও। বাংলায় ছিল চুনো ও দেশি ছোট মাছের বিপুল সম্ভার। মৌরলা, পুঁটি, সরপুঁটি, খয়রা, ভেদা, চেলা, ট্যাংরা, ন্যাদোস, বেলে, ফ্যাসা, বাচা, বান, মাগুর, দাঁড়কে, ইচলা, কাজলি, খরশুলা, উলকো, আমোদি, কেঁকলে, সোনাখোড়কে, চাঁদা, পায়রাচাঁদা, বাতা, খোলসে, চ্যাং, ল্যাটা, ফলুই, শিঙি, কই একদা-সমৃদ্ধ এই তালিকার অনেক মাছই এখন বিলুপ্ত বা প্রায়-বিলুপ্ত। তবে আশার কথা, অনেক জায়গাতেই এখন বেসরকারি উদ্যোগে চুনো মাছ সংরক্ষণ এবং চাষের আয়োজন চলছে। এমনকী পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতেও এখন দেশি মাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
শুধু আহারে বৈচিত্রের জন্যই নয়, পুষ্টির দিক থেকেও চুনো মাছ অনন্য। পুষ্টির নিরিখে চুনো মাছ অনেক ক্ষেত্রেই রুই, কাতলা বা ইলিশের থেকে এগিয়ে। গ্রামের প্রসূতি এবং অপুষ্ট শিশুদের পুষ্টিকর আমিষ আহার জোগাতে পারে দেশি প্রজাতির ছোট মাছ। কেবল গর্ভবতীরাই নয়, সদ্য প্রসূতিদের পুষ্টির জন্যও মৌরলা
মাছের তুলনা নেই।
চুনো মাছ তো দুর্লভ বটেই। বড় মাছের চাহিদাও কি মেটাতে পারছে রাজ্য? মন্ত্রী এ দিন স্বীকার করেন, রাজ্যে চাহিদার তুলনায় মাছের উৎপাদন কম। তিনি জানান, বাংলার মোট চাহিদার ১২ থেকে ১৪ শতাংশ মাছ আসে অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং ওড়িশা থেকে। অর্থাৎ মৎস্যপ্রিয় বাঙালির পাতে আমিষ জোগাতে ভরসা সেই ভিন্ রাজ্যই। |