এ যেন মরুভূমিতে মরূদ্যান! সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও রোগীদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের ‘জেনেরিক’ নাম লেখার ব্যাপারে চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই যেখানে এখনও মুখ ঘুরিয়ে রয়েছেন, তখন এসএসকেএম হাসপাতালের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের আউটডোরটি সেখানে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
শুধু কলকাতা নয়, রাজ্যের নিরিখেই একটি বড়সড় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন ওই বিভাগের চিকিৎসকেরা। এবং ঘটিয়েছেন প্রায় নিঃশব্দেই, পাঁচ বছর আগে। সে নিয়ে বিস্তর বক্রোক্তিও হজম করতে হয়েছে তাঁদের। পাঁচ বছর ধরে ওই বিভাগের আউটডোরে চিকিৎসকেরা জেনেরিক নামে ওষুধ লিখছেন। ‘কম্বিনেশন ড্রাগ’ ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রেই ওষুধের ব্র্যান্ড লেখা হয় না বলে দাবি বিভাগের চিকিৎসকদের। নিয়মিত লিখতে হয়, এমন কিছু ওষুধের নামে রাবার স্ট্যাম্পও বানিয়ে ফেলেছেন তাঁরা। রোগীরা সেই প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাসপাতালের ফার্মাসিতে গিয়ে ওষুধ নেন। চিকিৎসকদের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখানোর ব্যাপারে আগের সরকারের চেষ্টা সফল হয়নি। তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই একই চেষ্টা শুরু করায় ওঁদের আশা, এ বার হয়তো পরিস্থিতি বদলাবে।
এই বিভাগটিকে সামনে রেখে আশাবাদী হয়ে উঠছে স্বাস্থ্য দফতরও। স্বাস্থ্যকর্তাদের আশা, রাজ্যের সব চেয়ে নামী সরকারি হাসপাতালের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ যদি পথ দেখায়, তা হলে ধীরে ধীরে অন্যরাও হয়তো তা অনুসরণ করবে। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনও কোনও চিকিৎসক জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লিখছেন। কিন্তু একটি গোটা বিভাগ যদি লেখে, তবে তা অন্যদের কাছেও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা এটি অন্যদের সামনেও তুলে ধরার চেষ্টা করব।”
সরকারি চিকিৎসকদের জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখার কথা বরাবরই। কিন্তু ওষুধ সংস্থাগুলির নানা প্রলোভনে এবং জেনেরিক নামের ওষুধ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকায় কোনও দিনই তা মানা হয় না। বছর তিনেক আগে এ বিষয়ে নির্দেশ জারি করেছিলেন বাম সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র। কিন্তু সেই নির্দেশ তেমন গুরুত্বই পায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও ক্ষমতায় আসার পরে ফের বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়। ফের জারি হয় নির্দেশ। কিন্তু এ বারেও প্রতিক্রিয়া আলাদা কিছু হয়নি।
এসএসকেএমের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের চিকিৎসক সতীনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “অন্যান্য হাসপাতালে ইন্ডোরে ইনসুলিন নিখরচায় দেওয়া হয়। এসএসকেএমে শুধু ইন্ডোর নয়, আউটডোরেও তা দেওয়া হয়। সেই কারণেই জেনেরিক নাম লেখার বিষয়টি আমাদের মাথায় আসে। খাওয়ার ওষুধও জেনেরিক নামেই লেখা হয়। দিন দিন যে ভাবে ওষুধের দাম বাড়ছে, তাতে জেনেরিক নামে ওষুধ না লিখলে সাধারণ মানুষ চিকিৎসার সুযোগই পাবেন না।”
তাঁরা নজির গড়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে যে একেবারে সমস্যা হচ্ছে না, তেমন নয়। বিভাগের চিকিৎসকেরা জানালেন, সরকারি হাসপাতালে জোগানের ঘাটতি থাকলে রোগীরা খানিকটা সমস্যায় পড়েন। জেনেরিক নামের প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাইরের দোকানে গেলে বহু সময়েই ওষুধ মেলে না। কারণ, বেশির ভাগ দোকানেই ফার্মাসিস্ট থাকেন না, জেনেরিক নাম বুঝে ওষুধ দেবেন কে? সরকারি উদ্যোগে হাসপাতালগুলিতে ওষুধের দোকান খোলার প্রকল্প (জনওষধি) চালু হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়নি। চালু হলেও সফল হয়নি।
সতীনাথবাবু বলেন, “এ দেশে একই ওষুধ ২০টি ব্র্যান্ডে বাজারে বিক্রি হয়। এটাও কোনও সভ্য দেশে হয় না। কোনও নিয়ম চালু করতে গেলে পরিবর্তনটি শিকড় থেকেই আসতে হবে। না হলে তা পূর্ণাঙ্গ চেহারা পায় না।” |